বাংলাদেশ জাতিসংঘ টিমের সম্প্রতি সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যায় আক্রান্তদের জন্য মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত এলাকাসমূহ পরিদর্শন

আকস্মিক বন্যায় আক্রান্তদের সাহায্যের জন্য জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় জরুরি ত্রাণ তহবিল পাঁচ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করে
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি গ্রাম আনোয়ারপুর । সবুজ গাছ-গাছালি আর নীল পানির এই নিসর্গে প্রায় ৫০০০ মানুষের বাস । সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি-গোয়াইন - বৃহৎ এই তিনটি নদীর সংলগ্ন ভূমিতে অবস্থিত এই গ্রাম বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদী ভাঙ্গনের মতো অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা । ২০২২ সালের গ্রীষ্মে আকস্মিক বন্যা এই অঞ্চলে হানা দেয়ায় নারী ও শিশুরা সর্বাধিক দুর্ভোগের মুখে পড়ে।
আকস্মিক বন্যায় আক্রান্তদের সাহায্য করার জন্য জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় জরুরি ত্রাণ সহায়তা তহবিল (CERF) আকস্মিক বন্যা দুর্গতদের মানবিক ত্রাণ সহায়তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত জেলাগুলোর ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে বৃহৎ পরিসরে ছয় মাস মেয়াদী সর্বমোট পাঁচ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ প্রদান করে। পরিকল্পনায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কার্যক্রমগুলোর মধ্যে - খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকার ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ও পয়ঃ নিষ্কাশন এবং বাস্তুচ্যুত নারী ও শিশুদের সুরক্ষা।
গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ দল বিভিন্ন প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে সে সম্বন্ধে অবগত হওয়া এবং বন্যা দুর্গত লোকজনের সাথে কথা বলার জন্য উক্ত দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। বিভিন্ন জাতিসংঘ সংস্থার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে উক্ত টিম শান্তিগঞ্জের শিশু সুরক্ষা কেন্দ্রসমূহ পরিদর্শন করেন। তারা আনোয়ারপুর গ্রামের পুষ্টি, পানি, পয়ঃ নিষ্কাশন এবং হাত ধোয়ার সুবিধাসমূহ পরিদর্শনের পাশাপাশি সুনামগঞ্জের অন্যান্য এলাকাস্থ বিভিন্ন খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র, নারীদের জন্য বহুমুখী নিরাপদ কেন্দ্রসমূহ এবং বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
"আমরা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানতাম না। এখন আমরা আমাদের ব্যবহারের জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখার চেষ্টা করি", আনোয়ারপুর গ্রামের শেফালী আক্তার, ২৪ বছর বয়সী দুই সন্তানের মা, জাতিসংঘ টিমকে বলেন।

আনজুমান নামে দেড় বছরের একটি শিশু বারো দিন যাবত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। সে গুরুতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত। "জন্মের পর থেকেই সে সব সময় অসুস্থ থাকে, তবে আমি জানতাম না তার কি সমস্যা হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও এর সহায়তায় তাকে কয়েকবার ডাক্তার (CERF এর সহায়তায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে) দেখানো এবং দেহে পুষ্টির অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার দেহে গুরুতর তীব্র অপুষ্টি ধরা পড়ে এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । আনজুমানকে হাসপাতালে ভর্তি করা এবং ওষুধপত্র বাবদ তারা আমাদেরকে টাকা দেন", আনজুমানের মা তার অভিজ্ঞতার কথা জানান। আনজুমানের মা ছাড়াও হ্যাপি, খুশনাহার এবং এই গ্রামের অন্যান্য নারীরা বলেন যে, সিইআরএফ এর সহযোগিতার ফলে তারা এখন ভালোভাবে জীবন যাপন করছেন। "পুরো ব্যাপারটা আমাদের কাছে একেবারে নতুন; আমরা এখনো এসব স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো চর্চা করার চেষ্টা করছি এবং এই ধরনের প্রকল্পগুলো চালু রাখা দরকার", তারা বলেন।
ত্রাণ সহায়তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জাতিসংঘ শিশু তহবিল স্থানীয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) সহায়তা প্রদান করেছে। এক্ষেত্রে ইউনিসেফ উচ্চ ঝুঁকিগ্রস্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য রেফারেল সহায়তা ও কনসালটেশন সেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রচন্ড জ্বর, তীব্র ডায়রিয়া, বিভিন্ন চর্মরোগ, মূত্রনালীর বিভিন্ন সংক্রমণ ও দেহের বিভিন্ন আঘাতের চিকিৎসায় নানা ধরনের ঔষধ সরবরাহ করেছে। সংস্থাটি সর্বাধিক বন্যাকবলিত জেলাসমূহে অনেক সমাজকর্মী নিয়োজিত করেছে এবং সঠিকভাবে হাত ধোয়ার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং মহিলা অধিদপ্তরের সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে বন্যা আক্রান্ত শিশু, নারী ও বালিকাদের সহায়তার জন্য ইউনিসেফ খাদ্য নয় এমন ৪৫৭৫ টি প্রয়োজনীয় জিনিস (পরিবার ও মর্যাদা রক্ষাকারী এবং বিনোদনমূলক বিভিন্ন কিট) বিতরণ করেছে।

বন্যা কবলিত এলাকায় বসবাসকারী গর্ভবতী নারীদের জন্য সহায়তা ছিল সিইআরএফ কর্তৃক অর্থায়িত কার্যক্রম সমূহের মধ্যে একটি। সিইআরএফ তহবিলের সহায়তায় নিয়োজিত সমাজকর্মীগণ গর্ভবতী নারীদের যত্ন নিচ্ছিলেন। তারা ওই নারীদেরকে প্রয়োজনীয় সকল সেবা প্রদান করেন। বন্যা কবলিত এলাকায় যে সকল মিডওয়াইফ গর্ভবতী নারীদের যত্ন নিচ্ছিলেন, তাদেরকে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রদান করা হয়েছে। এই মিডওয়াইফদের সহায়তায় গত বছর নভেম্বর মাসে নয়টি শিশুর জন্ম হয়েছে।

সুনামগঞ্জের ভিমখালী ও দিরাই এলাকায় জেন্ডার সমতা ও নারীদের ক্ষমতায়ন বিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা ইউএন উইমেন চিকিৎসা সেবা ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি অল্প বয়সী মেয়েদের মাঝে জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
গ্রামীণ হাওর এলাকায় যে সকল ক্ষুদ্র কৃষক আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের জন্য খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জরুরী ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যে তিনটি গুরুতর দুর্যোগ কবলিত জেলার ঝুকিগ্রস্ত ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, সেগুলো হলো: সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা। সুনামগঞ্জ জেলার ফজিলত বেগম, ৫৬ বছর বয়সী এই মহিলা বন্যায় একটি বাছুর হারান এবং মা গরুটার জন্য খাবার জোগাড়ের চেষ্টায় ছিলেন। "আমার একমাত্র বাছুরটা বন্যায় ডুবে মরেছে, কিন্তু গাভিটা কোনভাবে বেঁচেছে যদিও এটা কষ্ট পাচ্ছিল, কারণ এটা অপুষ্টিতে ভুগছিল", তিনি বলেন। এফএও কর্তৃক জরুরি পশু খাদ্য সরবরাহের ফলে ফজিলতের বাকি গরুটা শক্তি ফিরে পেয়েছে।
বন্যা কবলিত গ্রামবাসীদের সহায়তা প্রদানের জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। সংস্থাটি গ্রামবাসীদের জন্য খাদ্য, পুষ্টির পরিপূরক খাবার এবং অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে।
সার্বিক বিচারে, স্থানীয় মানবিক ত্রাণ সহায়তা প্রদানকারী বিভিন্ন অংশীদার ও বাংলাদেশ সরকারের সাথে মিলিতভাবে ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, ডাব্লিউএফপিএ, এফএও, এবং ইউএনওমেন সংস্থাসমূহের মাধ্যমে সিইআরএফ কর্তৃক অর্থায়িত বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে।