১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় তুতসিদের ওপর গণহত্যার ২৮তম বার্ষিকীর আন্তর্জাতিক প্রতিফলন দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এর বাণী
০৭ এপ্রিল ২০২২
আজ আমাদের অবশ্যই অসহনশীলতা, যুক্তিহীনতা ও গোঁড়ামি প্রতিটা সমাজের জন্য কতটা বিপজ্জনক, তা স্বীকার করে নিতে হবে।
১৯৯৪ সালে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে নিহত ১০ লাখ মানুষকে আমরা একত্রে শ্রদ্ধা জানাই - নিহত ওই মানুষগুলোর সিংহভাগই তুতসি জনগোষ্ঠীর, তবে তাদের মধ্যে মধ্যপন্থী হুতু ও অন্যান্যরাও রয়েছে যারা গণহত্যার বিরোধিতা করেছিল।
আমরা তাদের স্মৃতির প্রতিসন্মান প্রদর্শন করছি ।
ওই গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রক্রিয়ায় আমরা সংহতি জানাই।
এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসেবে আমরা আমাদের ব্যর্থতার কথাও স্মরণ করছি।
গণহত্যাটি দুর্ঘটনাও ছিল না বা অনিবার্যও ছিল না।
এটি নির্বিচারে, পদ্ধতিগতভাবে - এবং প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত হয়েছে।
যারা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখে অথবা এ-সংক্রান্ত সংবাদ দেখেছেন, তাদের কেউই ওই সহিংসতার কথা অস্বীকার করতে পারবে না।
এরপরও মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষ কথা বলেছিল- এবং তার চেয়েও কম মানুষ হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছিল।
আরও অনেক কিছু করা যেত - এবং করা উচিত ছিল।
ওই ঘটনার পর একটি প্রজন্ম কলঙ্কের দাগ নিয়ে টিকে আছে।
২৮ বছর আগের সেই রক্তপাত স্মরণের ক্ষণে আমাদের মেনে নিতে হবে যে আমাদের সামনে সবসময়ই বিকল্প পথ থাকে।
বিদ্বেষ ছেড়ে মানবতাকে বেছে নেওয়ার, নিষ্ঠুরতার পরিবর্তে সহমর্মিতাকে বেছে নেওয়ার, আত্মপ্রসাদের পরিবর্তে সাহসিকতাকে বেছে নেওয়ার এবং উন্মাদনার পরিবর্তে সমাধান খোঁজার পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ সবসময়ই থাকে আমাদের ।
সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বশীলতার মূলনীতিই হচ্ছে নৃশংস অপরাধ সংঘটনের সময় আমরা নীরব থাকব না।
এ্যাকশন ও অন্যান্য উদ্যোগের মাধ্যমে আমার আহ্বান হলো, আমরা যা কিছুই করি না কেন তার সবকিছুতেই মানবাধিকার সমুন্নত থাকতে হবে।
গণহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক আমার বিশেষ উপদেষ্টা গণহত্যার ঝুঁকি এবং অন্যান্য নৃশংস অপরাধ চিহ্নিত করতে বিশ্বজুড়ে সব ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখছেন।
এবং আমি প্রতিরোধের এজেন্ডাকে আমাদের সব কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছি ।
আজ, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা যদিও তা নিখুঁত নয়, দেখিয়েছে যে অপরাধীরা আর ছাড় পাচ্ছে না।
রুয়ান্ডা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ফৌজদারি ট্রাইব্যুনাল- যা ইতিহাসের প্রথম আদালত, যেখানে গণহত্যার অভিযোগে প্রথম কারও বিচার হয়েছে- এই প্রচেষ্টার কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এবং এটি দেখিয়েছে টেকসই শান্তির জন্য ন্যয়বিচার কতটা অপরিহার্য।
রুয়ান্ডা আজ গভীরতম ক্ষত থেকে সেরে ওঠার এবং অন্ধকারতম খাদ থেকে জেগে উঠে শক্তিশালী সমাজ গঠনে মানব সক্ষমতার শক্তিশালী সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
অবর্ণনীয় জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হওয়া সত্ত্বেও আজ পার্লামেন্টের আসনের ৬০ শতাংশ নারীদের দখলে।
এবং রুয়ান্ডা এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সেনা প্রেরণকারী চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। যে ব্যথা তারা নিজেরা সহ্য করেছে, তা যেন অন্যদের ক্ষেত্রে না ঘটে এ কারণেই ঝুঁকি জেনেও নিজেদের সেনাদের পাঠাচ্ছে রুয়ান্ডা ।
তুতসিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা যে প্রশ্ন তুলেছে, তা মানবসভ্যতার সবক্ষেত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে- নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকা, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের কার্যকারিতা, আন্তর্জাতিক অপরাধে অপরাধীকে ছাড় দেওয়ার প্রবণতার সমাপ্তি, সহিংসতার উৎস চিহ্নিতকরণ এবং শিষ্টাচারের ভঙ্গুরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আমাদের সামনে রয়েছে বড় পরীক্ষা ।
আজ, ইউক্রেনে আগুন জ্বলছে, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এর বাইরে নতুন-পুরোনো সংঘাত ক্ষত সৃষ্টি করছে।
নিরাপত্তা পরিষদ এমন পরিবেশ সৃষ্টিতে একমত, যেখানে ক্রীড়নক রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তির ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে, অসমতা ও দারিদ্র্য বাড়ছে- এবং এগুলোর সবই অসন্তোষ, উদ্বেগ ও ক্ষোভ সৃষ্টি করছে।
এরমধ্যে, আমরা অনলাইন ও অফলাইনে বাড়তে দেখছি , ঘৃণামূলক বক্তব্য, অমানবিক ভূল তথ্য, বর্ণবাদী বক্তব্য এবং গণহত্যার অস্বীকৃতিসহ বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য ।
আজ আমাদের অবশ্যই অসহনশীলতা, যুক্তিহীনতা ও গোঁড়ামি প্রতিটা সমাজের জন্য কতটা বিপজ্জনক, তা স্বীকার করে নিতে হবে।
আসুন, অনুতাপের সঙ্গে অতীতের দিকে তাকানোর পাশাপাশি সংকল্প নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে ও তাকাই।
আসুন আমরা সতর্ক থাকার এবং কখনো ভুলে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহন করি।
আসুন আমরা রুয়ান্ডার সেইসব মানুষকে অর্থপূর্ণভাবে স্মরণ করি, যারা সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সহনশীল ভবিষ্যত এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
ধন্যবাদ।