বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এর বাণী
০৫ জুন ২০২২
৩০০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষয়িষ্ণু বাস্তুতন্ত্রের কারণে ক্ষতির শিকার। দুষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। ১০ লাখের বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, যার অনেকগুলো খুব বেশি হলে আর মাত্র কয়েক দশক টিকতে পারবে।
এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের পৃথিবী একটিই’, যা বাস্তবতার একটি সহজ কথা। এই গ্রহটা আমাদের একমাত্র আবাস। কাজেই এর বায়ুমণ্ডলের স্বাস্থ্য, পৃথিবীর বুকে যে প্রচুর জীবন ও তার বৈচিত্র্য, এই গ্রহের বাস্তুতন্ত্র এবং এর সীমিত সম্পদ রক্ষা করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু তা করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। টেকসই নয় এমন জীবন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে আমরা আমাদের এই গ্রহটা থেকে অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষা করছি। পৃথিবীর প্রাকৃতিক ব্যবস্থা আমাদের চাহিদা মিটিয়ে যেতে সক্ষম নয়।
এটি কেবল পৃথিবীকে আহতই করছে না, আমাদেরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সকল মানুষ এবং ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট্যের সবগুলোর জন্যই জরুরি। প্রকৃতি আমাদের খাবার, নিরাপদ পানি, ওষুধ নিশ্চিত করে, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে এবং চরম আবহাওয়া থেকে আমাদের সুরক্ষা দেয়। কাজেই সুবিবেচনার মাধ্যমে প্রকৃতি ব্যবস্থাপনা এবং প্রকৃতির সেবাগুলো সবার, বিশেষত ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী ও সমাজের, সমহারে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা আমাদের জন্য জরুরি।
৩০০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষয়িষ্ণু বাস্তুতন্ত্রের কারণে ক্ষতির শিকার। দুষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। ১০ লাখের বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, যার অনেকগুলো খুব বেশি হলে আর মাত্র কয়েক দশক টিকতে পারবে।
বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ জলবায়ু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যাদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব যেমন প্রবল তাপ, বন্যা ও ক্ষরায় মৃত্যুর ঝুঁকি ১৫ গুণ বেশি। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনায় প্রতি বছর ২০ কোটিরও বেশি মানুষের বাস্তুচ্যূত হতে পারে।
পঞ্চাশ বছর আগে বিশ্বের নেতারা জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলনে একত্রিত হয়ে এই গ্রহটাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত সফল হতে পারিনি। প্রতিদিনই যে সতর্ক ঘণ্টা বেজে চলেছে, তা আর আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
সাম্প্রতিক স্টকহোম+৫০ পরিবেশ বৈঠকে সবাই একমত হয়েছেন যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট্যের সবগুলোই একটি স্বাস্থ্যকর গ্রহের ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন, দুষণ আর জীববৈচিত্র্য হারানোর ত্রিমাত্রিক সংকটের কারণে যে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে, সেই দুর্যোগ এড়াতে আমাদের সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
সরকারগুলোর জরুরিভিত্তিতে নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ও পরিবেশের সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যা টেকসই উন্নয়নকে তরাণ্বিত করবে। সব জায়গায় নবায়নযোগ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সবার জন্য কাঁচামাল সুলভ করা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো, ভর্তুকি বাড়ানো এবং বিনিয়োগ তিনগুণ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারকে নাটকীয়ভাবে তরাণ্বিত করতে আমি পাঁচটি সুপারিশ করেছি।
মানবতা ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই স্থিতিশীলতাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। একটি স্বাস্থ্যকর গ্রহ এই পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা শিল্পের মেরুদণ্ড।
এবং ভোটার ও ভোক্তা হিসেবে আমাদের অবশ্যই যে নীতি আমরা সমর্থন করি, তার থেকে শুরু করে আমরা যে খাবার খাই, যে পরিবহন পছন্দ করি, যে কোম্পানিকে আমরা সমর্থন করি- সবকিছুতেই পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করতে হবে।
নারী ও মেয়েশিশুরা বিশেষত পরিবর্তনের শক্তি হতে পারে। তাদের অবশ্যই ক্ষমতায়ন করতে হবে এবং সব পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ও প্রচলিত জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে এবং আমাদের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষায় এসব জ্ঞানের ব্যবহার করতে হবে।
ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে আমরা একসঙ্গে কাজ করলে এবং গ্রহটাকে সর্বাগ্রে রাখলে আমরা কী অর্জন করতে পারি। ১৯৮০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা যখন সতর্ক করলেন যে পৃথিবীর ওজন স্তরে মহাদেশের সমান ছিদ্র তৈরি হয়েছে যা প্রাণঘাতী হতে পারে, তখন প্রতিটা দেশ মন্ট্রিল প্রটোকল মেনে ওজন স্তর ক্ষয়কারী রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
১৯৯০-এর দশকে বাসেল সনদ উন্নয়নশীল দেশে বিষাক্ত বর্জ্য স্তুপীকৃত করা বেআইনি ঘোষণা করেছে। এবং গত বছর বহুজাতিক প্রচেষ্টায় লেড সমৃদ্ধ পেট্রোল উৎপাদন বন্ধ হয়েছে, যে পদক্ষেপ স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে এবং প্রতি বছর ১২ লাখের বেশি অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করবে।
২০৩০ সালের মধ্যে প্রকৃতির ক্ষতি প্রতিরোধে নতুন একটি বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে আলোচনা থেকে শুরু করে প্লাস্টিক দুষণ রোধে চুক্তি স্বাক্ষর পর্যন্ত বহুপাক্ষিক অংশগ্রহণে পরিবেশগত সংকট মোকাবিলার জন্য চলতি বছর এবং আগামী বছর বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্য আরও কিছু সুযোগ সৃষ্টি হবে।
জাতিসংঘ এসব পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কারণ, সামনে একটাই পথ- প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করা, এর বিরুদ্ধে নয়। একসঙ্গে আমরা কেবল আমাদের এই গ্রহটাকেই রক্ষা করতে পারি না, এর উন্নতিও ঘটাতে পারি। কারণ, আমাদের একটিই মাত্র পৃথিবী রয়েছে।