বাংলাদেশের খুলনা-বরিশালে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সাম্প্রতিক সফর জেন্ডার সমতাকে এগিয়ে নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেছে

বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর অফিসের  তত্ত্বাবধায়নে, এই তিনদিনব্যাপী জেন্ডার সমতা মিশনে জাতিসংঘের ৫ টি সংস্থা (ইউএন উইমেন, ইউএনএফপিএ, এফএও, ইউনিসেফ, আইএলও) প্রতিনিধিসহ তাদের উন্নয়ন এবং মানবিকসহায়তা দানকারী অংশীদাররা  (বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেন  ও জার্মানির এম্বাসী,  ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিগণ) অংশগ্রহণ করেন।

 এই সফর নিয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী  গোয়েন লুইস বলেন, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে নানা অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, আমরা খুলনা এবং বরিশালের প্রান্তিক নারী ও কিশোরীদের কাছ থেকে তাদের সমস্যার কথা শুনেছি  । তাঁরা প্রতিনিয়ত, বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বাধার মুখোমুখি হচ্ছে, যা নারীর ক্ষমতায়ন এবং জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা দূর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে, নারী ও মেয়েদের উন্নয়নে আরও কাজ করা প্রয়োজন এবং সেই সাথে উন্নয়নে নারীদের সমান  অংশীদার হতে হবে।  

প্রতিনিধি দল জলবায়ু ঝঁকিপূর্ন অঞ্চলে জেন্ডার বৈষম্য/অসমতা মোকাবিলায় পরিচালিত জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করেন এবং এই অঞ্চলের নারী ও মেয়ে এবং শিশুরা যে সমস্যাগুলির সম্মুখিন হচ্ছে তা নিয়ে স্থানীয় লোকজন এবং তাদের সাথে আলোচনা করেন।

ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টিটিভ গীতাঞ্জলী সিং বলেন, “মিশনের প্রতিটি দিন আমরা নারী ও মেয়েদের কাছে থেকে তাদের সংকল্প ও  সাহসিকতার কথা শুনেছি । যখন নারীর ক্ষতায়নের অগ্রগতি উর্ধ্বমুখী, তখন আমরা এখানে দেখছি জেন্ডার নিয়ে নানা পুরোনো নিয়মচার-কানুন মেয়েদের মধ্যে থাকা সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাধাগ্রস্ত করছে। জেন্ডার সমতার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে, যুবক, তরুণ এবং কিশোরদেরও একইসাথে কাজ করা অত্যান্ত জরুরী।  

বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের অংশীদার জেন্ডার সমতার পরিস্থিতি উন্নয়নে, নারীদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিক এবং আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো মোকাবেলায় নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে।

উদাহরনস্বরুপ, ইউএন উইমেন জাতীয় পর্যায়ে নারীদের অধিকার প্রচারে, এবং নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে নীতি ও আইনকে বাস্তবায়নে জোরালো ভুমিকা পালন করছে। ইউএন উইমেন  জেন্ডার-সহায়ক, মানবাধিকার-ভিত্তিক ,জলবায়ু কার্যক্রমের জন্য বিদ্যমান পরিকল্পনা এবং নীতিগুলি বাস্তবায়নের জন্য, পদ্ধতি এবং জেন্ডার রেস্পন্সিভ  তথ্য ব্যবহার করছে। ।

 আইএলও বাংলাদেশ অফিস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায়, শ্রমবাজারের চাহিদা মোতাবেক পরিবেশগতভাবে সচেতনতা, অন্তর্ভুক্তি, এবং আন্তঃসংযুক্ত শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নয়ন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে তরুণদের উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিতে কাজ করছে। আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর, টুওমো পোটিআইনেন বলেন - " আমরা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (TVET) ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা প্রদান; এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিকদের সংগঠনের সাথে কাজ করছি, যাতে নারীরা তাদের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে । তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের নারীরা শ্রমবাজারের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে আছে যা আংশিকভাবে শ্রমবাজারে তাদের কম অংশগ্রহণের জন্য দায়ী। এই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে আইএলও খুলনা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মতো কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (টিভিইটি) ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে যাতে পুরুষদের পাশাপাশি একই পদে কাজের জন্য নারীরা প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হয়”।

জাতিসংঘের খাদ্যও কৃষি সংস্থা মৎস্য কৃষি এবং জলজ কৃষি নীতির সাথে সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তন এবং জেন্ডারভিত্তিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ  করে। এই সংস্থার সহকারী প্রতিনিধি, নুর আহমেদ খোন্দকার বলেন, " আগে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের কথা শোনা হতো না কিন্তু  এখন নারীরা কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, জলজ চাষ প্রকল্পের মালিকানা গ্রহণ করছেন, পাইকারি বাজার ব্যবস্থাপনাসহ সক্রিয়ভাবে মাছ চাষে অংশগ্রহণ করছেন। ।” তিনি  আরও বলেন, “নারীদের ক্ষমতায়ন তাদের পারিবারিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে সাথে জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় সাহায্য করছে”।

জাতিসংঘের এ মিশনের কেন্দ্রবিন্দুই হল জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা (জিবিভি) রোধে পদক্ষেপ নেওয়া; এবং শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা। জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), খুলনা এবং বরিশাল বিভাগে জিবিভি, বিশেষ করে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে, সংস্থাটি চাইল্ড প্রোটেকশন কমিউনিটি হাব (CPCH) প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে সচেতনতামূলক সেশন, সমাজকর্মীদের রেফারেল সহায়তা, জাতীয় হেল্পলাইন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হয়। এই প্রসঙ্গে, ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি, শেলডন ইয়েট  বলেন,“দেশে বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর প্রথা প্রতিরোধে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহিংসতার মৌলিক কারণগুলি এবং সামাজিক রীতিনীতিগুলো  বোঝা এবংসহিংসতা মোকাবেলার জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদের এবং তাদের কমিউনিটিকে শক্তিশালী করা যাতে করে তারা সামাজিক পরিবর্তনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। "

ইউএনএফপিএ জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতার ঘটনায় মাল্টি-সেক্টরাল সেবা প্রদানের মাধ্যমে যা  প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোরীদের সম্পৃক্ত করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

ইউএনএফপিএ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টিটিভ ক্রিন্টিন ব্লোখুস বলেন, “জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের অভাবনীয় অগ্রগতি সত্বেও বরিশাল ও খুলনার মত অঞ্চলেও অসংখ্য নারী ও তরুণীরা প্রতিনিয়তই বাল্যবিবাহসহ শারীরিক, মানসিক ও যৌন সহিংসতার মত ঘটনার শিকার হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতার প্রতিরোধে ও প্রতিকারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এজন্য নারী ও কিশোরীদের শিক্ষা, দক্ষতার উন্নয়ন ও কাউন্সেলিং সেবার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।

এই সফরটি মূলত বাংলাদেশে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সহযোগিতা কাঠামো (ইউএনএসডিসিএফ) ২০২২-২০২৬ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়।  এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জেন্ডার সমতা এবং জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা নির্মূলসহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার ।