প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা: একজন মায়ের মনের পরিবর্তন
বাড়িতে দুইবার সন্তান জন্মদানের সময় বিপ্জ্জনক অবস্থার মুখে পড়ায়, রুমা তার তৃতীয় কন্যা রুহির জন্মের সময় ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
“আমার প্রথম দুই মেয়ের জন্ম হয়েছিল বাড়িতে। আমার প্রচণ্ড ব্যথা ও কষ্ট হয়েছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণও হয়েছিল, কিন্তু বাচ্চা বের হচ্ছিল না। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমার পরিবারও ভয় পেয়েছিল,” আগের ঘটনা স্মরণ করে রুমা খাতুন বলেন।
মাত্র ২৪ বছর বয়সেই রুমাকে দুই বার বাড়িতে বিলম্বিত প্রসবের কারণে প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
তার প্রথম সন্তান জ্যোতির জন্ম হয় যখন রুমার বয়স মাত্র ১৬ বছর। পাঁচ বছর পর তার দ্বিতীয় সন্তান রাইসার জন্ম হয়। দুই সন্তানই নিরাপদে পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু তাদের জন্মের সময়ের অভিজ্ঞতা রুমা ও তার স্বামী জহিরুল ইসলামের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে আছে।
এ বিষয়ে জহিরুল বলেন, “বাড়িতে সন্তান জন্মদানে মায়েদের সহায়তা করেন এমন একজনকে খুঁজতে বের হতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি। কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম।”
সৌভাগ্যবশত তাদের তৃতীয় সন্তান রুহির জন্মের সময়ের অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। তিন মাস আগে ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট রায়গঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে১ নিরাপদে রুমার কনিষ্ঠ এই সন্তানের জন্ম হয়।
তৃতীয়বার গর্ভধারণ নিয়ে দুশ্চিন্তা
বাংলাদেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের ধামাইনগর গ্রামে রুমা তার স্বামী জহিরুল, তাদের কন্যা সন্তান, দুই দেবর ও শাশুড়ির সঙ্গে থাকেন। তাদের বাড়ি প্রধান সড়ক থেকে বেশ দূরে এক ধান ক্ষেতের পাশে অবস্থিত, আশেপাশে তেমন কোন বাড়িঘর নেই।
রুমা বলেন, “আমাদের বাড়ি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অনেক দূরে এবং কাছাকাছি যে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে সেখানে কোনো মানসম্পন্ন মিডওয়াইফ (ধাত্রী) নেই। বৃষ্টি হলে রাস্তা কাদায় ভরে যায়। তখন ওই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি চলে না। অসুস্থ অবস্থায় আমরা কোথাও যেতে পারি না। সে কারণে আমি বাড়িতেই সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।”
রুমার মতো তার গ্রাম ও লোকালয়ের আরও অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারী বাড়িতেই সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এটা যে শুধু দীর্ঘ দিনের সামাজিক বিশ্বাসের কারণে হয়ে আসছে এমনটি নয়, প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের বসবাস এবং বাড়িতে কম খরচে প্রসব সম্ভব বলে মনে হওয়াটাও এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে।
এ বিষয়ে, ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট রায়গঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ধামাইনগরহাট কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করা মিডওয়াইফ সাগরিকা রানি মাহাতো বলেন, “এখানকার বেশির ভাগ মা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে চান না। মায়েদেরকে হাসপাতালে যেতে রাজি করানোটাই আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
জহিরুল ও রুমা দম্পতি বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম, বাড়িতে সন্তান জন্মদানে খরচ কম পড়বে। কিন্তু বাড়িতে একজন ধাত্রী আনতে গিয়ে আমাদের অনেক বেশি খরচ পড়েছে।”
“আমি তার ওপর ঠিক ভরসাও করতে পারছিলাম না। আমি খুব ভয়ে ছিলাম,” বলেন রুমা।
রুমা যখন বুঝতে পারলেন, আবার গর্ভধারণ করেছেন তখন তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তীব্র প্রসব বেদনা, যন্ত্রণায় কাতরানোর সেই স্মৃতি মুহূর্তেই ফিরে আসল, যেন গতকালকেরই ঘটনা সব।
রুমার সাহায্য প্রয়োজন।
কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, মিডওয়াইফ এবং মনের পরিবর্তন
গর্ভধারণের তিন মাসের মাথায় রুমার দেখা হয় কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী২ সাদিয়া ইসলামের সঙ্গে, যিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের মায়েদের ধামাইনগর কমিউনিটি ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছিলেন। যে কমিউনিটি ক্লিনিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ‘রিচিং এভরি মাদার অ্যান্ড নিউবর্ন’ (আরইএমএন) কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। দেশজুড়ে এই কর্মসূচি বিস্তৃত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ১০ উপজেলায় এটা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগের আরইএমএন কর্মসূচির বর্তমান লক্ষ্য দেশের সব জেলায় মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের হার ৮০ শতাংশে উন্নীত করা আর জাতীয়ভাবে তা ৯০ শতাংশে নিয়ে আসা। এর প্রধান লক্ষ্য এটা নিশ্চিত করা যে, ভবিষ্যতে যেন কোনো মা ও শিশু অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা থেকে বাদ না পড়েন। ”
নিজের ও সন্তানের সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো সেবা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে রুমা ধামাইনগরহাট কমিউনিটি ক্লিনিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে মিডওয়াইফ সাগরিকার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগের কর্মসূচির আওয়তায় পরিচালিত প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন সাগরিকা। তাতে মায়েদের শুধু স্বাস্থ্য পরীক্ষাই নয়, গর্ভধারণকালে করণীয় নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার বিষয়েও প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন তিনি।
সাগরিকা বলেন- “আমি অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের সন্তান জন্মের আগে, সন্তান জন্মের সময় এবং সন্তানের জন্মের পরে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি।”
রুমা বলেন, “তিনি বিনা খরচে আমার রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করান। তার কাছ থেকে আমি নানা পরামর্শও পেয়েছিলাম। যেমন গর্ভধারণকালে আমার ও বাচ্চার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কী কী উপসর্গ দেখা দিতে পারে, পুষ্টিকর খাবার বিষয়ে এবং প্রসব বেদনা উঠলে কোথায় যেতে হবে- সে সব বিষয়ে তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।”
সাগরিকার কাছ থেকে যত্ন সহকারে সেবা ও অনুপ্রেরণা পেয়ে রুমা ও তার স্বামী সিদ্ধান্ত নেন, তার তৃতীয় সন্তানের জন্ম হবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। হাসপাতালে গিয়ে সন্তান জন্মদান প্রচলিত রীতির বাইরে হলেও রুমা অন্তর থেকে জানতেন, তাঁর নিজের ও সন্তানের নিরাপত্তাই তাদের প্রথম চাওয়া হওয়া উচিত।
রুহি, অফুরন্ত আনন্দের উৎস
তিন মাস বয়সী রুহি সব সময় খুব হাসিখুশি থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে কৌতূহলও অনেক বেশি তার। রুহির গালের সঙ্গে গাল মিশিয়ে, তার হাতের আঙুল ধরে মা রুমা আনন্দে উদ্বেলিত হন।
রুমা বলেন, “ওর জন্মের সময় আমার মনের জোর ছিল অনেক বেশি। কারণ সেখানে দক্ষ মিডওয়াইফরা ছিলেন। তাঁরা আমার সন্তান জন্মদানে সহায়তা করেছেন। তাদের সেবায় আমার মনে হয়েছিল, আমার সন্তান সুস্থ হবে এবং আমিও সুস্থ থাকব।”
কয়েক মাস আগে কোনো জটিলতা ছাড়াই রুমার সন্তানের জন্ম হয়। এখনো তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষার (চেক-আপ) জন্য ধামাইনগরহাট কমিউনিটি ক্লিনিকে আসছেন। বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগের এই কর্মসূচির আওতায় ২০২৩ সালের জুন থেকে এখন পর্যন্ত রুমার মতো আরও সাড়ে নয় হাজারের বেশি গর্ভধারিণী মা সন্তানের জন্ম পূর্ববর্তী সেবা নিয়েছেন। এই সংখ্যা চলতি বছরের শেষ নাগাদ ১৫ হাজার ৪২৫ জন প্রসূতিকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্য অর্জনের পথেই আছে।
নিজেও দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা রুমার সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল, তার সন্তান যেন সুস্থভাবে সুস্বাস্থ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, পড়াশোনায় ভালো হয় এবং তারা দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারেন। এখন তিন মেয়েকে নিজেদের মধ্যে খেলতে, হাসতে দেখে রুমা বুঝতে পারেন, তিনি তার স্বপ্ন পূরণের পথেই আছেন।
_________________________
১ সরকার পরিচালিত গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র
২ তিনি "পরিবার কল্যাণ সহকারী" নামেও পরিচিত, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনার জন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কাজ করার জন্য মনোনীত।
বাংলাদেশে মা ও নবজাতকদের স্বাস্থ্য সেবা ও কল্যাণের জন্য অব্যাহত সহায়তা ও অপরিমেয় অবদানের জন্য গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে ইউনিসেফ। সবার জন্য টিকা নিশ্চিতে কানাডা সরকারের উদ্যোগ ‘ক্যানগিভ’-এর মানবিক সহায়তার তহবিল থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় এই জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার বাড়ছে।