‘সুইমসেফ’ কর্মসূচি: ভয়কে জয় করে মীম আক্তারের এগিয়ে যাওয়ার গল্প
সুইমসেফ কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংকট মোকাবিলা করা হচ্ছে। এখানে সাঁতারের মতন জীবনরক্ষাকারী দক্ষতা শেখানোর মধ্য দিয়ে ভয়কে জয় করে তৈরি
২০২০ সালের মার্চের এক পড়ন্ত বিকেলে ১৭ বছর বয়সী মীম আক্তারের জীবন সম্পূর্ণ এক নতুন দিকে মোড় নেয়। তার ৮ বছর বয়সী ভাই আল আমীন একটি গাছে উঠতে গিয়ে পুকুরে পড়ে যায়। একমাত্র ছোট ভাই পানিতে ডুবে যাচ্ছে দেখে মীম প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। ভাইকে উদ্ধারের জন্য তৎক্ষণাৎ সে পানিতে ঝাঁপ দেয়।
ওই সময়ের কথা মনে করে মীম বলে, “আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি আমার ভাইকে হারিয়ে ফেলছি। বাবা আমাকে সাঁতার শেখানোয় আমি তাকে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। কিন্তু বারবার আমার এটাই মনে হচ্ছিল যে- যদি আমি সাঁতার না জানতাম তাহলে কী হত?”
মীম খুব ছোট থাকতেই তার বাবা মারা গেছেন। সে কারণে ভাই আল আমীনকে সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব তারই কাঁধে পড়েছে। এই ঘটনা তার মধ্যে গভীর দাগ কেটেছে। শুধু নিজের ভাই নয়, এলাকার সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চিন্তা এখন তার মাথায় চেপে বসে। শিশুদের সাঁতার শেখার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সে উপলব্ধি করতে পারে; বিশেষ করে তাদের গ্রামে, যেখানে খাল-বিল, পুকুর-ডোবার মতো অনেক জলাধার রয়েছে।
মীম নিয়মিত সাঁতার অনুশীলন করতে থাকে এবং খুবই দক্ষ হয়ে ওঠে। ২০২২ সালে তাদের পাশের গ্রামে পানিতে ডুবে একজনের মৃত্যুর হলে মীম অনুধাবন করে যে একন আর কেবল চিন্তা করলে চল্বে না, বরং কাজে নামতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে যায়। শিশুদের সাঁতার শেখানোর তার স্বপ্নের কথা তুলে ধরে। সাঁতারের অনেকগুলো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতেছিল মীম। সাঁতারে তাঁর দক্ষতার বিষয়ে আগে থেকেই অবগত ছিলেন প্রধান শিক্ষক। তিনি (প্রধান শিক্ষক) মীমকে কথা দেন, তার স্বপ্ন পূরণের যে কোনো সুযোগ এলে তাকে জানাবেন।
বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংকট
বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু, একটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০ জন১ শিশুর এভাবে মৃত্যু হয়ে থাকে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি; পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনার ৭৫ শতাংশই ঘটে বাড়ির কাছের প্রাকৃতিক জলাধারে। এদেশে ঘন ঘন বন্যা হওয়ার প্রবনতাও এই সংকট বাড়িয়ে তোলে।
এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (এমওডব্লিউসিএ) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইউনিসেফ দেশের সবগুলো বিভাগ থেকে নির্বাচিত ২৮টি জেলায় ‘সুইমসেফ’ কর্মসূচি চালু করেছে। যেসব জেলায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে, সেসব জেলাকে এখানে বেছে নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে মীম আক্তারের এলাকা - মানিকগঞ্জ জেলার সাঁটুরিয়ার ডুল্লা গ্রামও রয়েছে। মীম তার সাঁতারের শিক্ষকের কাছ থেকে এই উদ্যোগের কথা জানতে পারে। এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হতে মীমকে একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়; পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মীম পাঁচ দিনব্যাপী সাঁতার এর প্রশিক্ষণ ও দুই দিন ব্যাপী প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেয়। এখন মীম কমিউনিটি সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছে। তার সাঁতার প্রশিক্ষনের ফলে অনেক কমিউনিটির অনেক শিশু দুরঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছে। এ কাজের জন্য মীম বৃত্তি পায় যা সে তার লেখাপড়ার কাজে ব্যবহার করে।
ইউনিসেফের সহায়তায় এবং সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর বাস্তবায়নে, সুইমসেফ কর্মসূচি ডুল্লা গ্রামে শিশুদের সাঁতার শেখানোর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের আনন্দের সঙ্গে সাঁতার শেখানোর জন্য পুকুরের মাঝে অল্প পানিতে বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। বাঁশগুলো এমনভাবে আধা নিমজ্জিত অবস্থায় রাখা হয়েছে যেন সেগুলো ধরে শিশুরা সাঁতারের চর্চা করতে পারে। নির্দিষ্ট এই এলাকার মধ্যে সাঁতারের অনুশীলন করে দক্ষ হওয়ার পরেই শিশুরা বেশি পানিতে সাঁতার কাটতে যায়।
শিশুদের জন্য নিরাপদ জলাশয়, নিরাপদ একটি কমিউনিটি
সুইমসেফ কর্মসূচির আওতায় মীম ২০২২ সালে ২০০ শিশু এবং ২০২৩ সালে আরও ২০০ এরও বেশি শিশুকে সাঁতার শিখিয়েছে। অনুকূল আবহাওয়া যখন থাকে সে সময় তিন মাস শিশুদের সাঁতার শেখানো হয়। এক্ষেত্রে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ অনুশীলন হয় স্কুল শেষে, যাতে শিশুরা সহজে অংশ নিতে পারে।
এ বিষয়ে মীম আক্তার বলে, “আমি এলাকায় সাঁতার শেখানো শুরু করার পর আমার গ্রামে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর কোনো ঘটনা ঘটেনি। নিজে একজন সুইমিং ইনস্ট্রাক্টর (সাঁতার প্রশিক্ষক) হয়ে ওঠা, এলাকার শিশুদের সাঁতার শেখানো এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বপ্ন সত্যি হওয়ায় আমি খুব খুশি। এই শিশুরা আবার সারা বাংলাদেশে অন্য শিশুদের সাঁতার শেখাতে পারবে।”
দুই সন্তানের জননী পারভীন আক্তার তার ছোট সন্তান পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা স্মরণ করেন। তার সন্তানের জীবন বাঁচিয়েছিল আল আমীন, মীমের সেই ছোট ভাই। মীমের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি প্রথম ধাপেই সুইমসেফের আওতায় সাঁতার শিখতে আগ্রহী শিশুদের দলে নিজের সন্তানদের নাম লিখিয়েছিলেন। পারভীন বলেন, “আমাদের এলাকার অনেক বাড়ির পাশে প্রচুর জলাধার রয়েছে। সে কারণে শিশুরা যখন খেলতে বাইরে যায় তখন কেউ আঘাত পায় এবং কেউ পানিতে ডুবে যায়। আবার আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে আমার ঘরেও পানি চলে আসে।”
অনেক বাড়ির বাবা-মা দুজনেই কাজের জন্য বাইরে যান। তখন শিশুরা বাড়িতে একা থাকে। এতে বাড়ির কাছে জলাধারে তাদের ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেক শিশু যথাযথ নিরাপত্তা ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ জলাশয়ে সাঁতার শেখে। সেখানে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বা কোনো মানসম্পন্ন পরিদর্শকের তত্ত্বাবধান থাকে না। সুইমসেফ কর্মসূচির অংশ হিসেবে কমিউনিটি সুইমিং ইনস্ট্রাক্টারেরা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে পানিতে পড়ে যাওয়া শিশু বা ব্যক্তিকে উদ্ধার ও তার প্রয়োজনীয় প্রাথমিক সেবাদাতা হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। সুইমসেফ শুধু সাঁতার শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এখানে উদ্ধারের কৌশল, সচেতনতা তৈরি এবং শিশুর পানিতে ডোবার জন্য দায়ী ক্ষতিকর সামাজিক চর্চাগুলো দূর করতে করণীয় বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়।
পুরো কমিউনিটির ক্ষমতায়নের লক্ষ্য
এই কর্মসূচির প্রভাব শুধু শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সাঁতার শেখানোর বাইরেও এর অনেক প্রভাব রয়েছে। এর আওতায় উঠান-বৈঠকের মাধ্যমে কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, শিশুশ্রম, নিপীড়ন-নির্যাতন এবং নানা ধরনের সহিংসতা ও বঞ্চনার মতো ক্ষতিকর সামাজিক রীতি-নীতি ও চর্চার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা হয়। কমিউনিটির সদস্য হিসেবে তাদের কী কী দায়িত্ব রয়েছে, সে বিষয়েও সচেতনতা তৈরি ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে তাদেরকে সহায়তা করা হয়। বাবা-মায়েরা জানতে পারেন যে কিছু সহজ পদক্ষেপ নেবার মাধ্যমেই শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। এই কর্মসূচির আওতায় বাবা-মায়েদের তাদের সন্তানদের বিশেষ করে কন্যাশিশুদের একেকজন ইনস্ট্রাক্টার (প্রশিক্ষক) হিসেবে নিবন্ধিত হতে এগিয়ে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়। এটা করা হয়ে থাকে জেন্ডার সমতামূলক সমাজ গড়তে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে।
বৈরী পরিবেশে জন্ম নিয়েও নিজের এলাকার শিশুদের জীবনরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে মীম। ছোটবেলা থেকে সে শিখে এসেছে, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর ভয় রয়েছে। এই ভয় এক সময় তাকেও তাড়িয়ে বেড়াতো। এখন সেই ভয়ের জায়গায় পানিতে ও এর আশপাশে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বপ্ন পূরণের সন্তুষ্টি তার মধ্যে এসেছে।
_________________________
১ বাংলাদেশ হেলথ্ এ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০১৬ (বিএইচআইএস ২০১৬)