এইচপিভি থেকে প্রতিবন্ধী মেয়েশিশুদের সুরক্ষা প্রদানে ড. নাজনীন আক্তারের নিরলস প্রচেষ্টা
প্রাণঘাতী জরায়ু মুখের ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ এই মা এবং চিকিৎসক অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন
“মাসিকের সময় আমার মায়ের অতিরিক্ত রক্তপাত ও শরীরে অনেক ব্যথা হতো। এক পর্যায়ে ব্যথা অসহনীয় অবস্থায় চলে গেলে, অস্ত্রোপচার করে তার জরায়ু অপসারণ করতে হয়। কারণ মা জরায়ু মুখের ক্যানসার রোগের উচ্চঝুঁকিতে ছিলেন এবং তার হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) টিকা নেওয়া ছিল না”- বললেন ড. নাজনীন আক্তার। তিনি সূর্যের হাসি ক্লিনিকের একজন চিকিৎসক (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) ও আলট্রাসনোলজিস্ট। ড. নাজনীন দুই সন্তানের মা। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) একজন মাস্টার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে নিযুক্ত টিকা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণও দেন তিনি।
জরায়ু মুখের ক্যানসার নিয়ে বাংলাদেশ ভয়ংকর এক বাস্তবতার সামনে দাড়িয়ে। প্রতিবছর এই রোগে ৫ হাজারের মতো নারীর মৃত্যু হয়। তবে এইচপিভি টিকার মাধ্যমে এই সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান বেরিয়ে এসেছে। ইউনিসফে, ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (গ্যাভি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ঢাকা বিভাগে এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে। এটি শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের অক্টোবরে। পরে তিনটি পর্যায়ে এই কর্মসূচি সারাদেশে সব বিভাগে বাস্তবায়ন হবে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মোট এক কোটিরও বেশি মেয়েকে এইচপিভি টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সবাইকে এই টিকা দেওয়া হবে বিনামূল্যে।
জরায়ু মুখের ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই
ড. নাজনীন আক্তার এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে পারেন ইপিআই সদরদপ্তরে একটি প্রশিক্ষণের সময়। জরায়ু মুখের ক্যানসার নিয়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাকে এবিষয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তার ছেলে ‘প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন’ এ লেখাপড়া করে । তিনি ঠিক করেন এইচপিভি টিকা নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে আলোচনা করবেন। প্রয়াস ইনস্টিটিউট একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, যা প্রতিবন্ধী শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে কাজ করে।
ড. নাজনীন বলেন, ‘‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একজন শিশুর মা হিসেবে তাদের বাড়তি যত্নের ব্যাপারে আমি সচেতন; বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে। একজন চিকিৎসক হিসেবে এবং আমার মায়ের দীর্ঘ-যন্ত্রণার কথা মনে করে প্রয়াস ইনস্টিটিউটের মেয়েদের মধ্যে যারা এইচপিভি টিকা নেওয়ার যোগ্য তাদের প্রাণঘাতী এই রোগটি থেকে সুরক্ষা প্রদানকে আমি আমার দায়িত্ব ও সুযোগ- দুটো হিসেবেই দেখেছি। আমার মেয়েকে তার স্কুলে টিকা প্রদানের পাশাপাশি আমার লক্ষ্য ছিল, ছেলের স্কুলে যেসব মেয়ে পড়াশোনা করে তাদের টিকা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।’’
এইচপিভি সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারনা ভেঙ্গে সচেতনতা বাড়ানো
প্রয়াস ইনস্টিটিউটে এই কর্মসূচি আয়োজন করার ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও ছিল। কারণ, এইচপিভি টিকা নিয়ে সমাজে কিছু ভ্রান্ত ধারনা বা ট্যাবু প্রচলিত রয়েছে। যেমন, একটি ভুল ধারণা হলো- ১২ বছর বয়সের পর এই টিকা অকার্যকর। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ভিত্তিহীন কিছু বিশ্বাসও রয়েছে। যেমন, এটি বন্ধ্যাত্ব তৈরি করতে পারে । এসব ভুল ধারণা ও ভিত্তিহীন বিশ্বাস সন্তানকে টিকা দিতে তাদের মা-বাবাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলে। তাই সম্প্রতি এই টিকা কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লক্ষ্য করা যায়, বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের ওপর এই টিকার সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিষয়ে বেশ আশঙ্কা করছেন, ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের অনাগ্রহ কাজ করছে।
ড. নাজনীন আক্তার দ্রুত স্কুলের শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এরপর স্কুলের অধ্যক্ষ তাকে শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে অভিভাবকদের সাথে কথা বলার এবং এইচপিভি টিকার গুরুত্ব ব্যখ্যাসহ এর সুরক্ষা ও কার্যকারিতা বিষয়ক বুকলেট বিতরণের সুযোগ করে দেন; তার এই আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে, আভিভাবকগন সঠিক তথ্য পেয়ে সচেতন হবার পাশাপাশি নির্দ্বিধায় এবং খুশিমনে তাদের মেয়েদের টিকাদানের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে। তাই, ড. নাজনীন আক্তার বিশ্বাস করেন, চিকিৎসকদের সরাসরি পরামর্শ, টিকা গ্রহণে অভিভাবকদের নিবন্ধন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে পারে।
প্রয়াসে একদিনের কর্মসূচিতে ২৫ জন মেয়ে এইচপিভি টিকা গ্রহণ করে। ঢাকা বিভাগে প্রাথমিক পর্যায়ে ১৩ জেলায় চার মাসে টিকা নেওয়ার যোগ্য ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১৯৩ জন মেয়ে এই টিকা গ্রহণ করে। টিকা গ্রহণের আগে তারা ভ্যাক্সি অ্যাপ অথবা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে।
ফারহানা আজাদ প্রয়াস ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তিনি বলেন, ‘‘আমার মেয়ে যাতে এইচপিভি টিকা নিতে পারে সেজন্য আজ আমি তাকে স্কুলে নিয়ে এসেছি। জরায়ু মুখের ক্যানসার নিয়ে সবসময় আমার দুঃশ্চিন্তা হয়। কারণ আমার একটি মেয়ে আছে এবং তাকে এইচপিভি টিকা দেওয়া না হলে যখন সে বড় হবে তখন এটি তাকে বিপদে ফেলতে পারে। এই টিকা সম্পর্কে যত তথ্য পাওয়া যায় তার সব আমি পড়ি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটি খুবই নিরাপদ। শিশুদের একটি স্বাস্থ্যকর ও আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত প্রদানে আমি সব বাবা-মাকে তাদের মেয়ের জন্য এই টিকার নিবন্ধন করতে পরামর্শ দিচ্ছি।’’
বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশে লাখ লাখ নারী জরায়ু মুখের ক্যানসারে মারা যায়। এটি এমন একটি রোগ যা অল্প বয়সী মেয়েদের মাত্র এক ডোজ টিকা দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে নারীদের যত ধরনের ক্যানসার হয় তারমধ্যে জরায়ু মুখের ক্যানসার দ্বিতীয় সর্বাধিক। আর ক্যানসারে যত মৃত্যু হয় তারমধ্যে সবচেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে জরায়ু মুখের ক্যানসারে। তারপরও এদেশের বহু মানুষ এইচপিভি’র বিপদ এবং এর টিকা নেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। ড. নাজনীন আক্তার বিশ্বাস করেন, এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং আরও বেশি মানুষকে এইচপিভির টিকা নিতে উৎসাহিত করতে সাধারণ মানুষের জন্য কাউন্সেলিং ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘‘ইউনিসেফ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতামূলক উদ্যোগ প্রয়াস ইনস্টিটিউটে এইচপিভি টিকা নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্য অভিভাবকদের কাছে এই টিকা সম্পর্কে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা শোনার পর ঘটনাস্থলেই অনেক অভিভাবক তাদের মেয়ের টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এভাবেই সমন্বিত প্রচেষ্টায় আমরা দেশ থেকে জরায়ু মুখের ক্যানসার নির্মূল করতে পারি।’’
ড. নাজনীন আক্তার তার প্রচেষ্টা, প্ররিশ্রম ও এডভোকেসি অব্যাহত রেখেছেন। যেসকল অভিভাবকগণ তাদের মেয়েদের জন্য নিবন্ধন করতে পারেননি, তাদেরকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আলোচনা পর্ব শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন বিষয়ে অভিভাবকদের নানা প্রশ্ন, এইচপিভি টিকা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা ও আস্থার বিষয়টি তুলে ধরে। এ থেকে আরও বোঝা যায় যে, দেশব্যাপী এইচপিভি টিকা বিষয়ক ক্যাম্পেইন চালিয়ে নেবার এখনই সময় । তাই এইচপিভির মতো নতুন টিকা কর্মসূচি সফল করতে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা ও স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মসূচিগুলোতে শিক্ষক, বাবা-মা ও বোর্ড কর্মকর্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।