জাতিসংঘের পিস অপারেশনস বিভাগের আন্ডার-সেক্রেটারি-জেনারেল জ্যঁ-পিয়ের ল্যাখো শান্তিরক্ষীদের সম্পর্কে বলেন, “শান্তিরক্ষীরা সাধারণ মানুষ, যারা কঠিন এবং অনেকক্ষেত্রে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে অসাধারণ সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করেন”। ১৯৪৮ সাল থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অনিরাপত্তামূলক পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন রক্ষা করে চলেছেন এবং জীবন বদলে দেওয়ার কাজ করে চলেছেন।
এ বছরে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “আমার মাঝেই শান্তির সূচনা”। এ প্রতিপাদ্যে অতীত ও বর্তমানের ইউনিফর্ম-পরিহিত ও বেসামরিক উভয় প্রকার শান্তিরক্ষীদের কর্ম ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি রয়েছে; শান্তিরক্ষীরা যেসব জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে চলেছেন, এ প্রতিপাদ্য তাদের সহনশীলতাকে ও ঘুরে দাড়ানোর শক্তিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এতে শান্তিরক্ষীদের অগণিত অর্জন ও সাফল্যের প্রতিফলনও রয়েছে। শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আজকের দিনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সবচেয়ে কার্যকর ও ফলপ্রসূ হাতিয়ারগুলোর অন্যতম। বেসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা বিধান ও মানবিক সাহায্য সরবরাহে সহযোগিতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সমাধান ত্বরান্বিত করা, মানবাধিকার জোরদার করা এবং টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো আজকের বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন ও জটিল চ্যালেঞ্জ।
যেসব শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন শেষে নিজ দেশে ফেরেন, তারা কীভাবে জাতিসংঘের নীতি ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে হয় সেই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে ফেরেন। কিন্তু কেবল শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দিয়েই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। শান্তির সূচনা ঘটে আমাদের প্রত্যেককে দিয়ে; সহিংসতা প্রতিরোধে এবং সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে কাজের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকেরই ভূমিকা রয়েছে। এমনকি যখন কোনো দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ থাকে না, তখনও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সুশীল সমাজ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ধর্মীয় মতাবলম্বী ও শরণার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করতে হয়। আরও বিভেদ এড়াতে এবং আমাদের সর্বজনীন মানবিক স্বার্থ সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধি জাগাতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সংলাপ একান্ত জরুরি।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বৃহৎ ভূমিকা পালনকারী দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১,৮৮,৫৫৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ৪০টি দেশে ৬৩টি জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশ নিয়েছেন; বর্তমানে ৭,৪৩৬ জন ইউনিফর্ম-পরিহিত শান্তিরক্ষী ১৩টি দেশে কর্মরত রয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবিচল ও অসাধারণ অবদানের জন্য আমি এ সুযোগে দেশটির প্রতি জাতিসংঘের প্রশংসা ব্যক্ত করতে চাই। ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে ১৬৭ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন, আমি তাদের পরিবারবর্গের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি, যে ২৫৯ জন শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালনকালে আহত হয়েছেন তাদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা জানাচ্ছি। গত বছরই বাংলাদেশ ছয় জন নিবেদিতপ্রাণ শান্তিরক্ষীকে হারিয়েছে। তারা হলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক মো. শরিফ হোসেন, সৈনিক মো. জাহাঙ্গীর আলম, সৈনিক মো. জসিম, ল্যান্স করপোরাল কফিল মজুমদার ও সার্জেন্ট মো. মনজুর রহমান এবং বাংলাদেশ পুলিশের কনস্টেবল মো. মনিরুজ্জামান। তাদের উত্তরাধিকার সকলের জন্য আরও শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পৃথিবী নির্মাণের অঙ্গীকার পালনে আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে।
বর্তমানে ৫৭২ জন বাংলাদেশি নারী শান্তিমিশনগুলোতে কর্মরত রয়েছেন। গত বছর তাদের সংখ্যা ছিল ৫১৯। এখন পর্যন্ত ২,৭২৮ জন নারী শান্তিরক্ষী সাফল্যের সঙ্গে জাতিসংঘের শান্তিমিশনগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুসারে বাংলাদেশ নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে এবং জাতিসংঘ এ ক্ষেত্রে আরও বৈচিত্র্যতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের ৭৫তম বর্ষ উদযাপনের এই লগ্নে আমরা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশের সদস্য এবং বেসামরিক শান্তিরক্ষীদের অভিবাদন জানাচ্ছি, যারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন।
বক্ত্যবটি ১৯টি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছেঃ
Daily Bangladesh Pratidin, Daily Jugantor, Daily Ittefaq, Daily Amader Shomoy, Daily Janakantha, Daily Sangbad, Daily Kalbela, Daily Bhorer Kagoj, Daily Desh Rupantor, Daily Shomoyer Alo, Daily Ajker Darpon, Daily Jaijaidin, Daily Shndhani Barta, The Financial Express, Daily Sun, The Daily Observer, Dhaka Tribune, Bangladesh Post, The Asian Age