ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা পরিবারদের সুরক্ষায় এগিয়ে আসছেন কমিউনিটি লিডাররা
০৫ অক্টোবর ২০২৩
ক্যাপশন: Sheuli's unwavering commitment to her community's health has never been more crucial, especially in the face of the alarming
dengue outbreak that has gripped Bangladesh.
শিউলি খাতুনরা পাড়া-মহল্লায় গড়ে তুলছেন সচেতনতা, প্রতিহত হচ্ছে ঢাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি ওয়ার্ড ধলপুর। নতুন একটি দিন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ধলপুর আলো ক্লিনিকে’র নিবেদিত ফিল্ড সুপারভাইজার শিউলি খাতুন স্থানীয় কমিউনিটিতে তার কাজ শুরু করার জন্য তৈরি হন। কমিউনিটির মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি তার দৃঢ় অঙ্গীকার এখন আরও বেশি গুরত্বপূর্ণ - বিশেষ করে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর উদ্বেগজনক প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে।
“আমরা বর্তমানে জোর দিচ্ছি ডেঙ্গু প্রতিরোধে, কারণ এটি ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে,” দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন শিউলি, “আমার কাজের এলাকা যাত্রাবাড়ী, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে ধলপুর। দুটি এলাকাকেই রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে কারণ এলাকা দুটি ডেঙ্গু সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।”
শিউলি ও তার স্বেচ্ছাসেবক দল ‘ধলপুর আলো ক্লিনিকে’র আশেপাশে বসবাসকারী কমিউনিটিতে কাজ করেন। ক্লিনিকটি শুধু স্থানীয় কমিউনিটির লোকজনকে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাই প্রদান করে না, একইসঙ্গে কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার একটি কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। ইউনিসেফের সহায়তায় তারা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে, তাদের সচেতন করতে।
ক্যাপশন: Sheuli Khatun speak to their community about dengue prevention in Dhalpur, Dhaka
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এবছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ৭ শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর রিপোর্ট করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস)। এ ছাড়া, ১৫ বছরের কমবয়সী ২৫ হাজারের বেশি শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে, যা উদ্বেগজনক।
অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ধলপুর এলাকাটি যেসব গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে শিউলি তার কথায় সেগুলো তুলে ধরেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, "ধলপুরে অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে অনেক এলাকায় পানি জমে থাকে, যা এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে।" স্বেচ্ছাসেবক দলটি ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে কমিউনিটির রাস্তা-ঘাট পর্যবেক্ষণে, পরিচ্ছন্নতামূলক কার্যক্রম পরিচালনায় এবং এলাকায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করায়।
শিউলি তার কমিউনিটিকে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান দিতে বদ্ধপরিকর। পরিস্থিতি কতটা কঠিন তা স্বীকার করে তিনি বলেন, "ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেকেই ৩-৪ দিন ধরে জ্বরে ভোগা সত্ত্বেও ক্লিনিকে আসেন না। কারণ তারা মনে করেন, এটি কেবল সাধারণ জ্বর।" এসব ক্ষেত্রে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তা বিশাল পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।তাই শিউলি এই রোগীদের স্থানীয় আলো ক্লিনিকে যাওয়ার পরামর্শ দেন, যেখানে রোগীরা দ্রুত চিকিৎসা নিতে পারে, ডায়াগনস্টিক টেস্ট করাতে পারে – সব বিনামূল্যে।
ক্যাপশন: Sheuli Khatun speak to their students about dengue prevention in Dhalpur, Dhaka.
তবে শিউলির প্রচেষ্টা কেবল ক্লিনিকের দরজাতেই থেমে থাকে না। তিনি সচেতনতা বাড়ানো ও কমিউনিটিকে সংগঠিত করার একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ, যে প্রচেষ্টায় ইউনিসেফ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। ইউনিসেফ মাঠ পর্যায়ে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের কাজ করছে, ডেঙ্গুর সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে। শিউলির মতো কমিউনিটি লিডার ও কমিউনিটির স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের জানা প্রতিটি কৌশল ব্যবহার করে জীবন-রক্ষাকারী বার্তাগুলো বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন। মাইকিংয়ের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে, লিফলেট বিতরণ করে, কমিউনিটি বৈঠকের আয়োজন করে এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে, ডেঙ্গু প্রতিরোধের বার্তা এখন পর্যন্ত ৭ কোটির বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।
প্যাম্ফলেট ও হ্যান্ড মাইক হাতে, শিউলি ও তার দল তাদের সচেতনতামূলক বার্তা নিয়ে কমিউনিটির দ্বারে দ্বারে যান। তারা রাস্তায় রিকশায় চড়ে প্যাম্ফলেট বিতরণ করে, হ্যান্ড মাইক ব্যবহার করে ধলপুরের বাসিন্দাদের মাঝে তাদের বার্তা ছড়িয়ে দেন। তারা স্থানীয় একটি সিটি করপোরেশন স্কুলেও যান, যেখানে তারা ডেঙ্গু-বিষয়ক সচেতনতামূলক উপকরণ বিতরণ করেন এবং প্রতিরোধের পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জানান।
ধলপুরের ব্যস্ত এক সবজির বাজারে তারা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেন, যেখানে শিউলি কমিউনিটির সম্মিলিত দায়িত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, "কমিউনিটিতে বসবাসকারী লোকদেরও কমিউনিটির প্রতি একটি দায়িত্ব রয়েছে – তাই আমরা তাদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি এবং ডেঙ্গু নির্মূলে তারা সবাই কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন সেটি তাদের বুঝতে সহায়তা করছি।"
ক্যাপশন: Tahmina Begum, a Community Volunteer, speaks to Imams at the mosque, along with community members, about dengue prevention in Dhalpur, Dhaka
শিউলি ও তার দল কমিউনিটির ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোর সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন। তারা ইমাম ও স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, উৎসাহ দেন যাতে তারা নিয়মিত নামাজের সময় ডেঙ্গু প্রতিরোধ নিয়ে কথা বলেন এবং মসজিদের লাউডস্পিকার ব্যবহার করে জীবনরক্ষাকারী তথ্য প্রচার করেন। এগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে শিউলি বলেন, "মসজিদগুলো কমিউনিটির মানুষের জমায়েতের স্থান, তাই এগুলো সম্ভাব্য হটস্পট – এই কারণে ইমামদের ডেঙ্গু সম্পর্কিত বার্তা প্রচার খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাদের মাধ্যমে কথা বলি, কারণ তারা কমিউনিটির লিডার এবং সবাই তাদের কথা শোনেন।"
ইউনিসেফ বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাথে কাজ করছে এবং মসজিদ ও কমিউনিটির জমায়েতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্পর্কে সঠিক ও কার্যকরী তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে কাজে লাগাচ্ছে। এ ছাড়াও ইউনিসেফ তরুণদেরকে তাদের কমিউনিটিতে পরিবর্তনের দূত হিসেবে সম্পৃক্ত করেছে, ডেঙ্গুর বিস্তার কমাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালনে তাদের ক্ষমতায়ন করেছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ডেঙ্গু নির্মূল করার জন্য সকলের সামগ্রিক প্রচেষ্টা কতটা প্রয়োজনীয় তা প্রতিফলিত হয়। শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপই নয়, ধীরে ধীরে কমিউনিটির ভেতরে সহনশীলতা গড়ে তোলাটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
একটি ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ
ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য অংশীদারদের সাথে একত্রে, সবার জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে ডেঙ্গু সংকট নিয়ন্ত্রণে নিবেদিতভাবে কাজ করছে।
শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ইউনিসেফ জরুরি ভিত্তিতে ২২ লাখ ৫০ হাজার ইউ এস ডলার সমমূল্যের প্রয়োজনীয় ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট ও পেশাদারদের জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, এবং পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধি খাতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী ও সেবা প্রদান করবে – যা ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম করার পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ এরকম একটি জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির মুখোমুখি আসায়, এটা স্পষ্ট যে শিউলির মতো ব্যক্তিদের এবং কমিউনিটিদের সংকল্প, এবং সরকার ও ইউনিসেফের মতো সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা সারাদেশে অরক্ষিত শিশু ও কমিউনিটির জীবন রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
লিখেছেন
অনিন্দ্য শুভ্র ব্যানার্জী
ইউনিসেফ
এই উদ্যোগে জাতিসংঘের যে সকল সংস্থা যুক্ত
ইউনিসেফ
জাতিসংঘ শিশু-বিষয়ক সংস্থা
এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা যে টেকসই লক্ষ্যগুলোকে সমর্থন দিচ্ছি