শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে হতাশাগ্রস্থ অভিবাসী থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প
০৭ নভেম্বর ২০২৩
৭ অক্টোবর ২০২৩
বাবা খুব অল্প বয়সে অবসরে যাওয়ায় নাসিম উস সাবাহ্র পরিবারের উপর ভয়াবহ দুর্দশা নেমে আসে। নাসিমের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায় সেসময়। এরকম পরিস্থিতিতে, ২০১৭ সালে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
নারায়নগঞ্জের এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে যোগাযোগ হয় নাসিমের। মালয়েশিয়াতে একটা চাকরির ব্যবস্থাও হয়ে যায়। বিনিময়ে নগদ ৪,১০,০০০ টাকা দিতে হয় দালালকে। এই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তখন নাসিমের পরিবারে ছিল না। আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার করে, সমিতি-এনজিও থেকে কিস্তিতে আর চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এই টাকা যোগাড় করতে হয় তাঁর পরিবারকে।
অবশেষে ২০১৭ সালের আগস্টে, নাসিম উস সাবাহ্সহ আরও ৩৪ জন ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন বুকে নিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রউনা হয়।
নাসিম মালয়েশিয়ার তিতিওয়াংসা প্রদেশে একটি ফাস্ট-ফুড রেস্তোরাঁয় চাকরি করেন যেখানে তাঁর প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হতো। চুক্তি অনুযায়ী নাসিমের থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ মাসে ২০,০০০ টাকা বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এজেন্সির পক্ষ থেকে। কিন্তু মালয়েশিয়া পৌঁছে তিনি দেখলেন বাস্তবতা অন্য রকম। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো দূরের কথা, তাঁর বেতনটাই তাঁকে ঠিকমত মিলতো না। মালয়েশিয়ায় এজেন্সির কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে গেলে দেখেন আরেক করুণ দৃশ্য। শুধুমাত্র বেতন নিয়ে অভিযোগ করতে আসায় অনেক প্রবাসীকে আটকে রেখে মারধর করা হয় সেখানে।
মাথার উপর বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপায় নাসিমের ছিল না। ঐ বেতনেই খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন তিনি।
এক টুকরো পাউরুটি ছিল তাঁর প্রতিদিনের দুপুরের খাবার। ভয়াবহ সেই দিনগুলোর স্মৃতিরোমন্থন করে তিনি বলেন, “আমার মনে পড়ে, প্রথম তিন মাসেই আমার ওজন ১৮ কেজির মত কমে যায়।”
এভাবেই দু’বছর কাটে নাসিমের।
এরপর, তাঁর ভিসার মেয়াদ যখন শেষ হতে চলে তখন তা রিনিউয়ের জন্য কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টা বিফলে যায়। নাসিম বুঝতে পারেন মালয়েশিয়ায় তাঁর বৈধতা হারালে নিয়োগকারীরা তাঁকে আরও শোষন করার সুযোগ পাবে। এই পরিস্থিতিতে, তাঁর এক মামার সাথে যোগাযোগ করেন যিনি পরবর্তিতে নাসিমকে বাংলাদেশে ফেরার ব্যাপারে সহায়তা করেন।
দেশে ফেরার পর নাসিম উস সাবাহ্ মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একদিকে তাঁর ও তাঁর পরিবারের উপর বিশাল ঋণের বোঝা। তার উপর এত টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে তারপর খালি হাতে দেশে ফিরে আসাটা তাঁর জন্য প্রচণ্ড লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
ফিরে আসার পর লজ্জা-হতাশায় প্রথম তিন মাস নাসিম নিজের ঘর থেকেই বের হতে পারতেন না। তারপর একটা সময় উপলব্ধি করলেন এইভাবে চলবে না। তাঁর একটা কাজের ব্যবস্থা করতেই হবে। একটা রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করলেন। কিন্তু সেখানেও বাঁধা হয়ে আসলো করোনা মহামারী। লকডাউনে তাঁর চাকরিটা চলে যায়। এরপর শুরু করেন খাবারের অ্যাপের ডেলিভারিম্যানের কাজ।
মালয়েশিয়াতে থাকতেই নাসিমের ওয়েব ডেভেলপমেন্ট নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু সময় এবং সুযোগের অভাবে সেসময় সেটা নিয়ে আর এগোনো হয়নি। এবার, খাবার ডেলিভারি থেকে আসা আয়ের অর্থ জমিয়ে নাসিম একটা ল্যাপটপ কিনে অনলাইনে ‘ওয়েব ডিজাইনিং’ শেখা শুরু করেন।
এরকম সময়েই নাসিম উস সাবাহ্ কুমিল্লায় ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সাথে অংশীদারিত্বে বাস্তবায়িত আইওএম এর ‘রিমেকার’ প্রকল্পের কথা জানতে পারেন। তাঁর কম্পিউটারটি যখন নষ্ট হয়ে যায়, রিমেকার প্রকল্পের থেকে তাঁকে একটি কম্পিউটার ইন-কাইন্ড সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়। এছাড়াও এই প্রকল্প থেকে ব্যবসা পরিচালনা এবং ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ নিয়ে তাঁকে কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এখন, নাসিমের নিজের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
নাসিম অত্যন্ত গর্বের সাথে বলেন, “আজকে আমরা সারা বিশ্বের গ্রাহকদের সেবা দিয়ে থাকি। আমার আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, আমার পরিবারকেও সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতে পারছি।”
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের এই ক্ষেত্রে নাসিম উস সাবাহ্ একজন প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ভবিষ্যতে ব্যবসাটা আরো বড় করে আরো মানুষের জন্য কাজের পথ তৈরি করার ইচ্ছা তাঁর। নাসিমের সবচেয়ে বড় ইচ্ছা তাঁর মত বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে সাবলম্বী হতে সাহায্য করা।