অপুষ্টি: শিশু নূরের গল্প
সমন্বিত পুষ্টি কেন্দ্রগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদের জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা প্রদান করছে
মাত্র ১৫ মাস বয়সে শিশু নুরকে অনেকের চেয়ে বেশি ধকল সইতে হয়েছে। তার বয়স যখন পাঁচ মাস তখন তার মা অসুস্থ হয়ে মারা যান। এরপর থেকে নূর ও তার ভাইয়ের দেখাশোনা করেন তাদের দাদা সৈয়দ ও দাদী সুবুরা।
নুরের বয়স যখন ছয় মাস, সেই সময়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার একটি নিয়মিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে একজন পুষ্টি বিষয়ক কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে তাদের ঘর পরিদর্শনে যান। তখন তিনি লক্ষ্য করেন, নুরকে বয়সের তুলনায় বেশ দুর্বল ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তার বাহুর উপরিভাগের পরিধি পরিমাপক (এমইউএসি) ফিতা দিয়ে মাপার সময় তাতে লাল রঙ প্রদর্শিত হলে স্বেচ্ছাসেবক বুঝতে পারেন, শিশুটি তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। এমইউএসি হচ্ছে বিভিন্ন রঙের কোড দিয়ে তৈরি একটি পরিমাপক, যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীরা দ্রুত বুঝতে পারেন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে কি না।
সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে সুবুরা বলেন, “নূরের অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল এবং প্রায়ই কাঁদত। আমরা ভেবেছিলাম সে বাঁচবে না।’’
পুষ্টি বিষয়ক কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক পরীক্ষা করার পর নূরকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য নিকটবর্তী একটি সমন্বিত পুষ্টি কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বলেন। দাদা-দাদি তাকে পুষ্টি কেন্দ্রে নিয়ে গেলে পুষ্টি বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবকরা তৎক্ষণাৎ তার পুষ্টির অবস্থা মূল্যায়ন করার জন্য তার উচ্চতা, ওজন ও বাহুর উপরিভাগের পরিধি (এমইউএসি) পরিমাপ করেন।
তাদের পরিমাপ অনুসারে, নূরের ওজন ছিল মাত্র ৪ কেজি এবং তার এমইউএসি পরিমাপের সময় লাল রঙ প্রদর্শিত হয় যা নিশ্চিত করে সে অপুষ্টির সবচেয়ে মারাত্মক রূপ ‘তীব্র অপুষ্টি’তে ভুগছে এবং গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে।
পুষ্টিজনিত একটি জরুরি অবস্থা
পুষ্টি বিষয়ক একজন পরামর্শদাতা সুবুরাকে বিভিন্ন ধরনের খাবারের বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন, যা নূরকে তার খাওয়ানো উচিত।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে শিশুদের মাঝে অপুষ্টির হার বেশি। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী১, শরণার্থী শিবিরগুলোতে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৫৭ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
সাজিয়া আফরিন মেসু এই পুষ্টি কেন্দ্রের একজন সেবিকা বা নার্স। তিনি দিনে ৩০-৩৫ জন শিশুকে সেবা দেন, যাদের মধ্যে ১০-১৫ জনই তীব্র অপুষ্টির শিকার। তিনি বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ হিসেবে যথাযথ খাবার ও যত্নের অভাবের কথা উল্লেখ করেন যা তাদের বারবার ডায়রিয়া, জ্বর ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার দিকে ধাবিত করে।
নূরকে পরীক্ষা করে নার্স সাজিয়া নিশ্চিত হন যে, তার অন্য ধরনের কোনো শারীরিক জটিলতা নেই এবং শিশুটির জন্য হাসপাতালের বহির্বিভাগের রোগীদের থেরাপিউটিক প্রোগ্রামের আওতায় তীব্র অপুষ্টির চিকিৎসা প্রযোজ্য। তিনি তাকে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থেরাপিউটিক ফুড (আরইউপিএফ) দিয়ে চিকিৎসা করা শুরু করেন, যা প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজে সমৃদ্ধ এবং শক্তিতে ভরপুর একটি বিশেষ ধরনের খাবার। কেন্দ্রের কর্মীরা পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শও প্রদান করেন যাতে সুবুরা তার নাতির স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়ে কীভাবে আরও ভালো যত্ন নিতে হয় তা শিখতে পারেন।
“আমি শিখেছি কীভাবে তাকে সঠিকভাবে আরইউএফটি এবং অন্যান্য নরম বৈচিত্র্যময় খাবার খাওয়াতে হয়, যা আমি আগে জানতাম না”- পরামর্শ পেয়ে কতটা উপকৃত হয়েছেন তা ব্যাখ্যা করে বলেন সুবুরা। তিনি আরও বলেন, “নূরকে খাওয়ানোর আগে আমার হাত ধুয়ে নিতে হবে, এটিও শিখেছি।’’
সুস্থতার পথে
পুষ্টি কেন্দ্রের ‘আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ কর্নারে নূরকে কলা খাওয়াচ্ছেন তার দাদা সৈয়দ।
চিকিৎসা শুরুর নয় মাস পর নূরের স্যাস্থের উন্নতি হতে দেখা গেলে তাকে বহিরাগত রোগীদের থেরাপিউটিক প্রোগ্রাম থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সমন্বিত পুষ্টি কেন্দ্রে সাম্প্রতিক একটি পরিদর্শনের সময় তার ওজন ছিল ৬.৮ কেজি যা তাকে প্রথমবার সেখানে চিকিৎসার জন্য পাঠানো সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ কেজি বেশি। যদিও নূর এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি, তবে সে আর মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে না; এখন তাকে মাঝারি ধরনের অপুষ্টির শিকার শিশুদের জন্য প্রযোজ্য সম্পূরক খাবার কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে।
দাদা-দাদির সঙ্গে বসে থাকার সময়ে নূরের আচরণেও তার উন্নতির লক্ষণ স্পষ্ট বোঝা যায়। পুষ্টি কেন্দ্রের ‘আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলভপমেন্ট’ কর্নারে তার দাদা সৈয়দ তাকে ধরে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খান। কারণ সে একটি হলুদ বল দিয়ে খেলার সময় বেশ জোরেসোরে দুই হাত ঝাঁকাচ্ছিল। তার ক্ষুধা বেড়েছে এবং দাদা তাকে একটি কলা দিলে সে আগ্রহের সঙ্গে সেটি খায়, মাত্র কয়েক মাস আগে যা ছিল বিরল এক দৃশ্য।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যবর্তী সময়ে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) সহায়তায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অতি তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত সাড়ে চার হাজারের বেশি শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এই সহায়তার মাধ্যমে ইউনিসেফ তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা ও যত্ন প্রদান করছে।
টানা দেড় বছর হতাশা ও অনিশ্চয়তার পর সুবুরা তার নাতির ক্ষুধা ও প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে ফিরে আসতে দেখে খুশি হয়েছেন।
সুবুরা বলেন, “আমি পরামর্শ প্রদানকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ এবং নার্সের প্রতিও, তাকে এই কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য। সে এখন খুব সক্রিয় ও প্রাণচঞ্চল। আমি আশা করি একদিন সে আমাদের কমিউনিটিতে একজন হাফেজ (ধর্ম প্রচারক) হতে পারবে।’’
____________________
1Source: Joint Response Plan (JRP) 2023