শারমিন ভেবেছিলেন নিউমোনিয়ায় তার তিন বছরের কন্যা ফাতিমাকে হারাতে বসেছেন। সৌভাগ্যবশত ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট অক্সিজেন সেবা ফাতিমার জীবন রক্ষা করেছে।
“আমার সন্তানের খিঁচুনি হচ্ছিল। আমার মাথা কাজ করছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব,” গত রাতের ঘটনা স্মরণ করে বললেন শারমিন সিদ্দিকী।
শারমিন যখন কথা বলছিলেন, ফাতিমার চোখে তখন ঘুম। ইউনিসেফের সহায়তায় দেওয়া অক্সিজেন সরবরাহের মেশিন থেকে ছন্দময় এক শব্দ হচ্ছিল, তারই তালে তালে তিন বছর বয়সী ফাতিমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।সবুজ রঙের স্বচ্ছ অক্সিজেন মাস্কের নিচে ঘুমন্ত শিশুটির মুখ ও নাক শান্ত দেখাচ্ছিল। ইউনিসেফ ও তার অংশীজনদের সহায়তায় হাসপাতালে রোগীদের জন্য অক্সিজেন সেবা চালু হওয়ায় তিন বছরের ফাতিমারকে শ্বাস নেওয়ার জন্য আর ভুগতে হয়নি।
খিুঁচনি, নিউমোনিয়া ও অপর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ
আগের দিন গভীর রাতে ফাতিমার খিুঁচনি ওঠে। ভয়ানক ওই মুহূর্তে শারমিনের মনে হচ্ছিল, তার একমাত্র সন্তানকে বুঝি ভোর পর্যন্ত আর বাঁচনো সম্ভব হবে না। জ্বরে আক্রান্ত ফাতিমাকে কোলে নিয়ে শারমিন বাসা থেকে বেরোলেন এবং দ্রুত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে উদ্দেশ্যে একটি রিকশা নিলেন।
শারমিন যখন মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালেন সঙ্গে সঙ্গে ফাতিমার আরেক দফা খিুঁচনি শুরু হল। ফাতিমার নিউমোনিয়া হয়েছে। এটা এমন একটি রোগ যা বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ। চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য হলেও নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য রোগে বাংলাদেশে অনেক শিশুর মৃত্যু হয় কেবল স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে রোগীদের অক্সিজেন সেবা প্রদানের পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত না থাকার কারণে।
ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স সুপারভাইজার ইফতি আরা বেগম বলেন, “যতক্ষণে রোগীর জন্য আমি একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতাম, ততক্ষণে অনেক ক্ষেত্রেই বেশ দেরি হয়ে যেত। কিন্তু আমরা এখন এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পেরেছি।”
কোভিড-১৯ এর সময়ও অক্সিজেন সেবা ছিল খানিকটা বিলাসিতা
ইফতি আরা বেগম অনেক বছর ধরে ফাতিমার মতো অসুস্থ শিশুদের সেবা দিয়ে আসছেন। এসব রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেনের অভাব কী হৃদয়-বিদারক পরিণতি বয়ে আনে, তা তিনি দেখে আসছেন। অনেক রোগী ও নবজাতকের অব্যাহত অক্সিজেন সরবরাহ প্রয়োজন হতো, কিন্তু অক্সিজেন সিলিন্ডার সীমিত হওয়ায় একজনের পরে আরেজনকে দিতে হতো। পরে যখন অক্সিজেন থেরাপি সহজলভ্য হল, তখন অক্সিজেন অবকাঠামো ও সরঞ্জামের কারণে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে গেল।
অক্সিজেন ঘাটতির বিষয়টি শুধু ইফতি আরার হাসপাতালে একবারই ঘটেছে এমন নয়, বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এই একই বাস্তবতা বিরাজমান ছিল। কোভিড-১৯ মহামারির সময় অক্সিজেন ঘাটতির বিষয়টি আরও বেশি পরিমাণে দেখা যায়; ফলে অক্সিজেন সংকটে থাকা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আরও বেশি চাপ পড়তে থাকে।
মহামারিকালে অক্সিজেন সংকটের বিষয়টি নজরে আসায় ইউনিসেফের সহায়তায় ২০২০ সালে এ বিষয়ে একটি পর্যালোচনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের ‘মা, শিশু ও নবজাতকদের ইউনিটে’ পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। কীভাবে নিরাপদে অক্সিজেন সরবরাহের সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়ে প্রায় ৮৮ শতাংশ চিকিৎিসকের প্রশিক্ষণ নেই। কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ‘অক্সিজেন মেনিফোল্ড সিস্টেম’ নেই।১
কিন্তু, অক্সিজেন ছাড়া ফাতিমার মতো অসুস্থ শিশুদের তো বাঁচানো সম্ভব না।
ফাতিমার সুস্থ হয়ে ওঠা
ফাতিমাকে দ্রুত এমন একটি শয্যায় দেয়া হয় যেখানে অক্সিজেন সরবরাহের সুব্যবস্থা আছে। ফাতিমার মা শারমিন এখন অনেকটা স্বস্তি পেয়েছেন।
ইউনিসেফের সহায়তায় এখন এই হাস্পাতালে ‘অক্সিজেন মেনিফোল্ড সিস্টেম’ চালু করা হয়েছে যার ফলে প্রতিটি রোগী তার শয্যাতেই পাইপলাইনের সাহায্যে কেন্দ্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে নিরাপদে অক্সিজেন সরবরাহ পাবে।
ফলে, ইফতি আরার মতো নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আর শয্যা থেকে শয্যায় অক্সিজেন সিলিন্ডার টানাটানি করতে হয় না। সেখানে রোগীরা তাঁর শয্যা থেকেই সহজে অব্যাহত অক্সিজেন সরবরাহ পেয়ে থাকেন।
ফাতিমার শয্যার উপরে থাকা অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে শারমিন বলেন, “আমার মেয়ে দ্রুতই অক্সিজেন সাপোর্ট পেল। এখান থেকেই তারা অক্সিজেন চালু করে দেন।” তিনি বলেন, “ঘণ্টাখানেক পর মেয়েটা ভালো অনুভব করতে থাকে। তার জ্বরও নেমে যায়। অক্সিজেন সহায়তা এখানে দারুণ ভূমিকা রেখেছে। এই অক্সিজেন চিকিৎসাই আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে। এখানে এই সেবা থাকাটা আমাদের সবার জন্য আশির্বাদ হয়ে উঠেছে। অক্সিজেন কোথায় আছে, তার জন্য অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে আমাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াতে হয়নি।”
একটি উন্নত ভবিষ্যতের টেকসই ভিত্তি
কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দাতা গোষ্ঠীর সহযোগিতায় ইউনিসেফ, বাংলাদেশ সরকারকে দেশজুড়ে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে নিরাপদ অক্সিজেন সরবরাহের অবকাঠামো গড়ে তুলতে এবং এ সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি নিশ্চিত করতে সহযগিতা করে।
এ বিষয়ে ইউনিসেফ বাংলাদেশের চিফ অব হেলথ মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, “একটি অক্সিজেন সিস্টেম দেখতে কেমন, সে বিষয়ে শুরুতে আমাদের ধারণা ছিল না। এই উদ্যোগের ফলে এটা নিয়ে আমরা আলোচনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য মানানসই একটি অক্সিজেন সিস্টেম গড়ে তুলতে পেরেছি।” ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “মহামারির এই সংকটকে আমরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার একটি সুযোগ হিসেবে নিয়েছি।”
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও ২০২২-২০২৩ সালে ৬০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অক্সিজেন মেনিফোল্ড কক্ষ ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের পাইপলাইন গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া ৩০টি হাসপাতালে স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিটের জন্য তরল মেডিকেল অক্সিজেন প্ল্যান্ট২ তৈরি এবং সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অক্সিজেন সেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলো মেরামত করা হয়েছে ও গ্যাস পাইপলাইন স্থাপণ করা হয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহের সরঞ্জামাদি কার্যকরভাবে ও নিরাপদে ব্যবহার বিষয়ে ৩০০ এরও বেশি স্বাস্থ্য সেবাকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে এক হাজারের বেশি স্বাস্থ্য সেবা কর্মী ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপকদের অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ইফতি আরা বেগম এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের একজন।
ইফতি আরা বলেন, “কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চিকিৎসা প্রদানকে আরও সহজ করে তুলেছে যার ফলে প্রত্যেকটি রোগী সময়মত অক্সিজেন পাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ শুধু কর্মস্থলেই আমাকে সাহায্য করছে না, বাসায়ও আমি এর সুবিধা পাচ্ছি। আতঙ্কিত না হয়ে কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সামাল দিতে হয়, সে বিষয়ে আমার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের আমি শেখাব।”
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই উদ্যোগের ফলে একটি জাতীয় মেডিকেল অক্সিজেন পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হল, বাংলাদেশের সবচেয়ে অসহায় শিশুরাও যেন দীর্ঘমেয়াদে অক্সিজেন সেবা পায়, তা নিশ্চিত করা।
ফাতিমার মতো সব শিশুর জন্য মানসম্পন্ন অক্সিজেন সেবা
২০২১ সাল থেকে ফাতিমার মতো বাংলাদেশের হাজার হাজার শিশু ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট এই উদ্যোগ থেকে সুবিধা পেয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে এবং শিশু ও নবজাতকদের সেবার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে ইউনিসেফ; যাতে ফাতিমার মতো প্রতিটি শিশুর জীবন বাঁচে এবং তারা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারে।
১ অক্সিজেন মেনিফোল্ড সিস্টেম স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের একটি জটিল উপকরণ, যেখানে মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহের একটি কেন্দ্রীয় ও আস্থাভাজন উৎস আবশ্যক। এখান থেকে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় এবং এই ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রজুড়ে অক্সিজেন সরঞ্জাম রাখা দরকার হয়।
২ একটি তরল মেডিকেল অক্সিজেন প্ল্যান্ট হল এমন একটি স্থাপনা যেখান থেকে তরল অক্সিজেন পাওয়া যায়। এই প্ল্যান্টে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে সেটাকে তরল আকারে নেওয়া হয়। পরে অন্যান্য গ্যাস থেকে অক্সিজেন আলাদা করা হয়।
বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে অব্যাহত সহায়তা ও অপরিমেয় অবদানের জন্য বিশ্ব ব্যাংক, দ্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, কানাডা সরকার, নরওয়ে সরকার, ইউকেএআইডি ও ইউএসএআইডির প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে ইউনিসেফ।
লিখেছেন
Nhi Tong
ইউনিসেফ
এই উদ্যোগে জাতিসংঘের যে সকল সংস্থা যুক্ত
ইউনিসেফ
জাতিসংঘ শিশু-বিষয়ক সংস্থা
অন্য যে সংস্থা এই উদ্যোগটিতে যুক্ত
BMGF
Bill & Melinda Gates Foundation
EOUK
Embassy of United Kingdom
GAC
Global Affairs Canada
MOFAONU
Ministry of Foreign Affairs of Norway
USAID
United States Agency for International Development
বিশ্ব ব্যাংক
বিশ্ব ব্যাংক
এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা যে টেকসই লক্ষ্যগুলোকে সমর্থন দিচ্ছি