বিশ্ব সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস, আমাদের শোভন কাজের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়
টুমো পৌটিয়াইনেন, কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইএলও বাংলাদেশ
প্রতিবছর ২০ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস’ আমাদের ব্যক্তিগতভাবে ন্যায়সঙ্গত হওয়া এবং একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ তৈরির গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি স্পষ্ট যে চলমান অন্যায়, কাজের অনিশ্চয়তা এবং সুযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অসাম্য বৈশ্বিক মনোযোগের দাবি রাখে।
সামাজিক ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরত্ত্ব বাড়ছে, এটিকে একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং স্থায়ী শান্তি এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ছিল দেশের শ্রমশক্তি। ২০২২ সালের বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, জনসংখ্যা অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার মোট ৬১.২ শতাংশ (পুরুষদের জন্য ৪০ শতাংশ এবং মহিলাদের জন্য ৪২.৮ শতাংশ), যা ২০১০ সাল থেকে শ্রমক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণে (৩৬ শতাংশ) উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বহুমাত্রিক হবার সাথে সাথে দেশের শ্রমশক্তি উচ্চ স্তরের দক্ষতা, উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন এবং উচ্চ পারিশ্রমিকসহ শোভন কাজের সুফলগুলো ভোগ করতে পারবে। বাংলাদেশ তার শ্রম খাতকে পুনর্গঠনের জন্য শোভন কাজের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় এবং অন্তর্ভুক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩৬টি আইএলও কনভেনশন এবং ১টি প্রটোকল অনুমোদন করেছে; শুধুমাত্র পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কনভেনশনগুলো ব্যতিরেকে দশটি মৌলিক কনভেনশনের মধ্যে আটটি অনুমোদন করেছে। উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে রয়েছে C138 অনুমোদন, ২০২২ সালের মার্চে Minimum Wage Convention 1973 অনুমোদন, এবং পরবর্তীতে কর্মসংস্থানের জন্য সর্বনিম্ন বয়স হিসাবে ১৪ বছর নির্দিষ্টকরণ।
বাংলাদেশ মার্চ ২০০১-এ C182, Worst Forms of Child Labour Convention, 1999 অনুমোদন করে এবং তারপর থেকে ৪৩টি সেক্টরে বিপজ্জনক শিশুশ্রমের তালিকা প্রকাশ ও আপডেট করে। অধিকন্তু, দেশের সরকার জুলাই ২০২৩ সালে, National Child Labour Survey 2022 -এর উপর অস্থায়ী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত শিশুদের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হ্রাস রেকর্ড করেছে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে Forced Labour Convention No. 29 এবং No. 105 অনুস্বাক্ষর করেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারীতে বাংলাদেশ ২০১৪ সালের Forced Labour Convention, 1930-এর প্রোটোকল অনুমোদন করে। সরকার, তার সামাজিক অংশীদার - শ্রমিক এবং নিয়োগকর্তাদের সংগঠনগুলোর সহযোগিতায়, সক্রিয়ভাবে শ্রম খাতে সংস্কারের কাজ করছে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে শ্রম খাতে (২০২১-২০২৬) শ্রম আইন, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন, শ্রম পরিদর্শন এবং ইউনিয়ন-বিরোধী বৈষম্য মোকাবেলা করার জন্য সরকারের পক্ষ হতে ILO Governing Body -কে একটি Roadmap of Actions এবং একটি জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা জমা দেয়া হয়৷
এই উদ্যোগগুলোর লক্ষ্য সমতা, শ্রম অধিকার, জেন্ডার সংবেদনশীল ক্ষমতায়ন এবং অংশগ্রহণ, যা সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তদুপরি, সরকার ILO এবং GIZ-এর সহযোগিতায় তৈরি পোশাক খাতে কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর জন্য শ্রমিক এবং তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি কর্মসংস্থান ইনজুরি স্কিমের কার্যকারিতা পরীক্ষা করছে। সরকার পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জাতীয় কর্মপরিকল্পনাও (২০২১-২০৩০) তৈরি করেছে এবং কর্মক্ষেত্রে একটি প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য National Occupational Safety and Health Training and Research Institute (NOSHTRI) নামক প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াধীন আছে। যখন শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ, সমান আচরণ ও সুযোগ, শ্রম অধিকার এবং ন্যায্য বেতন প্রদান করা হয়, তখন তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মর্যাদা সমুন্নত থাকে।
সামাজিক ন্যায়বিচারের অগ্রগতি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য, শ্রমখাতে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি এবং শ্রমিকদের অধিকারের প্রচারের পাশাপাশি তাদের দক্ষতা এবং নতুন প্রযুক্তিতে পুনঃদক্ষতা প্রয়োজন। এই প্রচেষ্টাগুলো আরও অবহিত, দক্ষ এবং ক্ষমতায়িত কর্মশক্তিতে অবদান রাখবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, আদিবাসী, অভিবাসী এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরাসহ দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য বিশেষভাবে গৃহীত নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যুব বেকারত্ব মোকাবেলা করা এবং অংশীদারদের মধ্যে মতের আদান-প্রদান উত্সাহিত করার মাধ্যমে একটি অধিকতর ন্যায়সঙ্গত শ্রম খাতের ভিত্তি আরো শক্তিশালী হবে। সর্বোত্তম অনুশীলনসমূহের বিনিময় এবং ন্যায্য শ্রম অনুশীলনের জন্য বিশ্বমান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গতবছর নভেম্বরে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ILO World of Work Summit-এ ILO Governing Body সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য একটি গ্লোবাল কোয়ালিশন গঠনের অনুমোদন দেয়, যে কোয়ালিশন কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ অনেক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য বিশ্ব নেতারা স্বাগত জানিয়েছেন।
সেখানে বাংলাদেশ সরকার বৈষম্য মোকাবেলা, সহযোগিতা, ন্যায্যতা, অন্তর্ভুক্তি, ত্রিপক্ষীয়তা এবং যুব ক্ষমতায়নের উপর জোর দেওয়াসহ সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়িত করার জন্য পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছে। The Global Coalition for Social Justice -এর লক্ষ্য হল সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবকে জরুরীভাবে মোকাবেলা করতে এবং শোভন কাজের এজেন্ডাকে ত্বরান্বিত করার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা জোরদার করা। বিশ্বব্যাপী সংহতি, নীতির সমন্বয় এবং ভিন্নধর্মী অংশীজনদের মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে শক্তিশালী, টেকসই, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা এর মূল লক্ষ্য।
Bangladesh Employers’ Federation (BEF) এবং Bangladesh Knitwear Manufacturers and Exporters Association (BKMEA)- সহ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত এই কোয়ালিশনের সদস্য সংখ্যা ১৪১। গ্লোবাল কোয়ালিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ টেকসই কাজের অনুশীলন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নীতিসমূহ গ্রহণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে জাতীয় এবং বৈশ্বিক উভয় পর্যায়ে বাংলাদেশকে শীর্ষস্থানে রাখে। এই অংশীদারিত্ব একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সম-অধিকারসম্পন্ন সমাজ গঠনে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গিকারের বহিঃপ্রকাশ।