বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের অভিমুখে সমন্বিত জাতীয় অর্থায়ন কাঠামোর ভূমিকা/গোয়েন লুইস, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী
২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উত্তরণের পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দেশটিকে সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রকার বিভিন্ন সম্পদ কার্যকরভাবে ও দক্ষতার সাথে কাজে লাগানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এ সকল গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকসমূহ অর্জন করার লক্ষ্যে জাতীয় অগ্রাধিকার সমূহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এমন বিভিন্ন উদ্ভাবনীমূলক অর্থায়ন সংক্রান্ত সমাধান বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । আর এখানেই সমন্বিত জাতীয় অর্থায়ন কাঠামোর (আইএনএফএফ) প্রাসঙ্গিকতা।
'আইএনএফএফ' হলো সরকারসমূহের জন্য প্রণীত একটি টুল বা ব্যবস্থা যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের জন্য নানাবিধ সম্পদ আহরণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়ন করার পাশাপাশি ২০৩০ এজেন্ডার সাথে সংগতি রেখে জাতীয় উন্নয়নের অগ্রাধিকারসমূহের অনুকূলে অর্থায়নের কৌশলগত একটি পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালে আদ্দিস আবাবা একশন এজেন্ডা এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ 'আইএনএফএফ' বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং অর্থায়ন নীতিমালা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সমন্বিত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।
'আইএনএফএফ' প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা কোন সহজ কাজ নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সংক্রান্ত অর্থায়ন আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, বিশেষ করে দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতগুলো কোভিড পরবর্তী তীব্র নেতিবাচক প্রভাবের মুখে পড়ায় রাজস্ব আয় নিম্নমুখী হয়েছে, জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ, যার ফলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে বিশেষ করে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার জনগণের ঝুঁকিগ্রস্ততা ও সহনশীলতা সংক্রান্ত চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিকন্তু, স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক বিশ্ব বাজারে প্রবেশের সুবিধার পাশাপাশি কনসেশনাল অর্থায়ন সুবিধাসমূহ হারাবে যার ফলে দেশের রপ্তানি ও বিনিয়োগের সম্ভাবনার উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
'আইএনএফএফ' এর কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক সীমাবদ্ধতা, রাজস্ব আয় ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্ন অসংগতি, বৈদেশিক ঋন সংক্রান্ত বিভিন্ন ঝুঁকি, প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য, সুশাসন, উপাত্তের সহজলভ্যতা ও সমন্বয় ব্যবস্থা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো বাংলাদেশকে সমাধান করতে হবে । অধিকন্তু, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত, বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষের সাথে এই দেশের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
এই চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলার জন্য এবং 'আইএনএফএফ' বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় বাংলাদেশ এর সহায়তায় জাতসংঘের চারটি সংস্থা - ইউএনডিপি, আইএলও, ইউ এনসিডিএফ এবং ইউএন উইম্যান - উন্নয়ন অর্থায়ন সংক্রান্ত মূল্যায়ন পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করার পাশাপাশি এসডিজি বিনিয়োগ শর্তাবলীসমূহ পুনঃ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তা করেছে এবং পানি ও পয়ঃ নিষ্কাশন (এসডিজি ৬), নবায়নযোগ্য জ্বালানি (এসডিজি ৭) ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কার্যক্রমসহের (এসডিজি ১৩) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য খসড়া রোড ম্যাপ প্রস্তুত করেছে। এছাড়া, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের অর্থায়ন কাজে লাগানোর জন্য নীতিমালা সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও সংস্কার কার্যক্রম এর পাশাপাশি অন্যান্য পক্ষের মাঝে সংলাপ ও অংশীদারিত্ব সুগম করার জন্য 'আইএনএফএফ' এ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে।
কাঠামো সংক্রান্ত হালনাগাদ দলিলাদির খসড়া তৈরি করা হলেও টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজন মোতাবেক বাজেট প্রণয়ন ও পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা, দেশীয় সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি, ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত এর অর্থায়ন কাজে লাগানো, সরকারি-ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত এর অংশীদারিত্ব উৎসাহিত করা, উদ্ভাবন ও শিল্পোদ্যোগ অব্যাহত রাখা এবং ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প সমূহের (এমএসএমই) জন্য অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গিয়েছে। প্রথাগত উৎসসমূহের পাশাপাশি উদ্ভাবনীমূলক বিভিন্ন অর্থায়ন ব্যবস্থা, যেমন মিশ্র অর্থায়ন (ব্লেন্ডেড ফিন্যান্স), সবুজ বন্ড, সামাজিক প্রভাব বন্ড, ডায়াসপোরা বন্ড, ইত্যাদি উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জসমুহ মোকাবেলা করতে পারে।
একটি শক্তিশালী জাতীয় অর্থায়ন কাঠামো বাংলাদেশ এর স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উত্তরণের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে পাথেয় হতে পারে। এজন্যে বিদ্যমান সম্পদের কার্যকর ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। । বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও পক্ষের মাঝে 'আইএনএফএফ' প্রক্রিয়া সমন্বয় করতে সক্ষম একটি শক্তিশালী তদারকি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি এই তদারকি কাঠামোতে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতসমূহ, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সহ সংশ্লিষ্ট খাতসমূহের প্রতিনিধিগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক অর্থায়ন নীতিমালা ও পদক্ষেপসমূহের অগ্রগতি ও প্রভাব চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে সহজপাঠ্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সহযোগীর নিকট টেকসই উন্নয়ন অর্থায়ন বিষয়ক কাঠামোর প্রতিবেদন নিয়মিত পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। অধিকন্তু, নাগরিক ও নীতি নির্ধারকদের মাঝে টেকসই উন্নয়ন অর্থায়ন এর গুরুত্বের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিত বহুপক্ষিক সংলাপ আয়োজন করতে হবে।
'আইএনএফএফ' হলো একটি চলমান প্রক্রিয়া যা নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা আবশ্যক । টেকসই উন্নয়নের জন্য সম্ভাব্য সকল উৎস থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের এই প্রচেষ্টায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে জাতিসংঘ বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।