বাংলাদেশে মৌসুমি বন্যার প্রাক-সংকট মূল্যায়ন
সমীক্ষার ফলাফলের কাঠামো
প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়গুলো বন্যার সময়রেখার মতো একই ক্রমানুসারে সাজানো চারটি বিভাগে বিভক্ত। এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য হলো, ঝুঁকি সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা কেমন এবং আগাম সতর্কতামূলক তথ্য ব্যবহারের প্রভাব, বন্যার আগে তারা কী করে, এসব প্রস্তুতি বন্যার প্রভাব ও তাদের পরবর্তী প্রয়োজন কীভাবে কমিয়ে আনে এবং এই ধারাবাহিকতার সব পর্যায়ে মানুষের কী ধরনের তথ্যের প্রয়োজন তা শনাক্ত করা।
ভূমিকা: জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হওয়া বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুম ভারী বৃষ্টি ও নতুন করে পানি সরবরাহের উৎস হওয়ার কারণে তা দেশের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। তবে এটি চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসে; জীবিকা, ফসল ও প্রাণিসম্পদকে প্রভাবিত করে। অত্যধিক বৃষ্টি ও বন্যা ফসলের ক্ষতি করে। অন্যদিকে বন্যার পানি গবাদি পশু ও পশুর আশ্রয়স্থলকে হুমকির মুখে ফেলে। কেউ কেউ অস্থায়ীভাবে আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। আবার কেউ কেউ বন্যার সময় গবাদি পশু রক্ষা করার জন্য পড়ে থাকে। বাংলাদেশে দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে প্রস্তুতি, আগাম ব্যবস্থা, মোকাবিলা ও পুনরুদ্ধার। এটি এইচসিটিটি ও জাতীয় ক্লাস্টার প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকারি সংস্থা, জাতীয় ও স্থানীয় সংস্থা (এল/এনএএস), আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা। জলবায়ু বিপর্যয় বিষয়ক ‘এইচসিটিটি নেক্সাস কৌশল ২০২১-২৫’ জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনার (এনপিডিএম) সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা, সম্ভাব্য পদক্ষেপ, বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য টেকসই সমাধান এবং মোকাবিলা ও ঝুঁকি হ্রাসে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানসহ রূপান্তরমূলক পরিবর্তনে গুরুত্বারোপ করে। প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থাকে মানবিক ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার বিষয়টি তুলে ধরার আন্তঃযুক্ত পন্থা হিসেবে দেখা হয়।
প্রাক-সংকট জরিপ পদ্ধতি: প্রাক-সংকট জরিপ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে মৌসুমি বন্যার সময় অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টার সমর্থনে পুরো সমন্বয় ব্যবস্থাকে উন্নত করা। সমীক্ষার উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে- সম্প্রদায়ের ধারণা, প্রয়োজন ও মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অনুধাবন করা এবং আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার পদক্ষেপের জন্য একীভূত আন্তঃখাতীয় ক্যাশ+ পদ্ধতির জন্য সুপারিশমালা প্রদান করা। বিশ্লেষণটি ফোকাস গ্রুপ বা দলগত আলোচনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার থেকে গুণগত উপলব্ধির সঙ্গে পরিমাণগত উপাত্তের সমন্বয় ঘটায়। প্রতিবেদনটি ভৌগোলিক আওতা, প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা, সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ায় পক্ষপাতদুষ্টতা এবং সীমিত গুণগত উপাত্তের উৎসের মতো সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে। তা সত্ত্বেও সহযোগিতামূলক এবং জনকেন্দ্রিক পদ্ধতি সমীক্ষার ফলাফলে বিশ্বাসযোগ্যতা ও দৃঢ়তা নিশ্চিত করে এবং ঝুঁকিতে থাকা সম্প্রদায়গুলোর জন্য দুর্যোগের প্রস্তুতি, পূর্বানুমান ও মোকাবিলার পদক্ষেপে একটি সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণের সুযোগ তৈরি করে।
ঝুঁকি উপলব্ধি এবং আগাম সতর্কতা: ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মৌসুমি বন্যার প্রতি বাংলাদেশের সংবেদনশীলতা তীব্র হয়েছে। এই সমীক্ষা অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর দিকে লক্ষ্য রেখে এই পুনরাবৃত্ত হুমকির বিষয়ে সম্প্রদায়গুলোর ধারণা বোঝার চেষ্টা করেছে। জরিপে উঠে এসেছে যে, মৌসুমী বন্যার প্রভাব তিনটি মাত্রায় বিস্তৃত: সম্পত্তি ও অবকাঠামোর ক্ষতি, জীবন ও জীবিকা ব্যাহত হওয়া এবং মানুষের দুর্দশা। জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি তাদের ঝুঁকির মুখে থাকার বিষয়টি প্রকাশ করা সত্ত্বেও মৌসুমি বন্যার মোকাবিলায় অভ্যস্থতার কারণে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রমাণ রয়েছে। তবে এই একই অভ্যস্থতা প্রায়শই সীমারেখা মুছে দিতে পারে, যার ফলে বন্যা মোকাবিলার নেতিবাচক পদ্ধতিগুলো 'স্বাভাবিক' বলে মনে হয়। যদিও আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রয়েছে, তবে তা যথেষ্ট সময়োপযোগী বা সমন্বিত নয়, যার কারণে প্রস্তুতির সময় মেলে কম। পরিশেষে, এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করবে- তা আস্থার বিষয়গুলো নির্ধারণ করে। সম্প্রদায়ের নিজস্ব জ্ঞান বা জানাশোনা কখনও কখনও পরিপূরক হয় আবার কখনও কখনও তা আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া আগাম সতর্কতাকে বাতিল করে দেয়। এটি আধুনিক পূর্বাভাসের সঙ্গে স্থানীয় জ্ঞানকে সংযুক্ত করার একটি উপায় নির্দেশ করে, যা আরও শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থায় পরিণত হয়। বাংলাদেশে মৌসুমি বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া ও মোকাবিলা করার জন্য একটি সমন্বিত, বহুমুখী ও সম্প্রদায়-অন্তর্ভুক্ত পদ্ধতির জরুরি প্রয়োজন।
মৌসুমি বন্যার জন্য পরিবারগুলোর প্রস্তুতি: মৌসুমি বন্যা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশকে ক্ষতির মুখে ফেলে, যার কারণে পরিবারগুলোর জন্য ঘুরে দাঁড়ানো ও প্রস্তুত থাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রায় ৭৫ শতাংশ পরিবার বন্যার ক্ষতি কমাতে বাড়ির ভিত উঁচু করা, শুকনা খাবার মজুত ও কলার ভেলা তৈরির মতো ব্যবস্থা নেয়। তবে জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশের মাঝে এখনও এই ধরনের ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বন্যায় ঘরবাড়ি ফেলে অন্যত্র যাওয়ার সময় পরিবারগুলো অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে শুকনা খাবার, প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও বিছানাপত্র সঙ্গে নেওয়াকে অগ্রাধিকার দেয়। তবে এ ধরনের আকস্মিক ঘটনা নিয়ে অনেকের কোনো বিশদ পারিবারিক পরিকল্পনা থাকে না। অর্থ খরচের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে খাবার, আশ্রয় এবং জল ও স্যানিটেশনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আর্থিক সিদ্ধান্তগুলো ঐতিহ্যগতভাবে সাধারণত পরিবারের পুরুষ প্রধানরা নিয়ে থাকেন। তবে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি ক্রমবিকাশমান ধারাও দেখা যাচ্ছে। আগাম পদক্ষেপ, বিশেষ করে বন্যার আগে নগদ অর্থ সহায়তা বিতরণকে প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। তবে সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়া ও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগের মতো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যদিও সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, তবে এখনও বিস্তৃত পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা (কাভারেজ) ও সহায়তার সুযোগ রয়েছে।
মোকাবিলার পর্যায়: প্রয়োজন ও মোকাবিলার কৌশল: শীর্ষ পাঁচটি তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে, নিরাপদ খাবার পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ (৪৩%), চাল ও মসুর ডালের মতো প্রয়োজনীয় খাদ্য প্যাকেজ (৪২%), টয়লেট মেরামত ও অস্থায়ী ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা (৩৩%) ), খাবার পানির উত্সগুলো মেরামত ও জীবাণুমুক্তকরণ (২৫%) এবং মানসম্মত শুকনা খাবারের প্যাকেজ (১৩%)। মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো আরও কিছু প্রয়োজন রয়েছে, যা বন্যা-পরবর্তী জন-জীবনের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। তবে এগুলো জরিপে কম মনোযোগ পেয়েছে।
বড় আকারের মৌসুমি বন্যার পর দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগের বিষয়ে ৬০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা আর্থিক ঘাটতিকে প্রধান উদ্বেগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অংশ খাদ্য নিরাপত্তাজনিত বিষয় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। উপাত্তে আর্থিক সমস্যা ও খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রধান উদ্বেগ হিসেবে উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পশুসম্পদ বা উত্পাদনশীল সম্পদ বিক্রির মতো নেতিবাচক কৌশলগুলোও কৃষকদের মধ্যে অধিকহারে দেখা যায়।
পরিবারগুলোর তথ্যের চাহিদা ও সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা: বন্যার ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে তথ্যের চাহিদা ও সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট যে স্থানান্তর প্রাথমিক উদ্বেগ হিসেবে রয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে একটি সক্রিয় স্থানীয়-পর্যায়ের পন্থা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়।
মোবাইল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার সত্ত্বেও মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া এবং প্রতিক্রিয়া চাওয়া- উভয় পক্ষের জন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এই অগ্রাধিকার সম্প্রদায়ের দৃঢ় সংহতি ও সম্মিলিত দায়িত্বের ওপর জোর দেয়। এ ছাড়া সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের সম্প্রদায় ও সাহায্য প্রদানকারীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। যদিও প্রযুক্তি, বিশেষ করে মোবাইল ফোন প্রতিক্রিয়া জানানোর একটি মাধ্যম হতে পারে, তবে উদ্বেগ জানানো ও প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততাকেই কমিউনিটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সামগ্রিকভাবে, এই অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য প্রত্যক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক সম্পৃক্ততার গুরুত্ব তুলে ধরে।
উপসংহার ও সুপারিশ: বাংলাদেশে মৌসুমি বন্যা মোকাবিলায় গবেষণায় দৃষ্টিপাত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা এবং এর প্রতি সম্প্রদায়ের আস্থা জোরদার করার জরুরি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কেননা বন্যায় অরক্ষিত থাকার বিষয়টি ঝুঁকির মুখে থাকা জনগোষ্ঠীর কেবল অর্ধেকই বুঝতে পারে এবং মাত্র এক তৃতীয়াংশ সময়মতো সতর্কতা পায়। পরিবারগুলোর প্রস্তুতি প্রশংসনীয়, যেখানে উল্লেখযোগ্য অংশের মাঝে ঝুঁকি কমানোর কৌশল সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। তবে ‘কাঁচা’ ঘরগুলো যে ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকে তা স্থিতিস্থাপক আবাসনের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
অর্থনৈতিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে, যা আর্থিক স্থিতিস্থাপকতামূলক পদক্ষেপ ও জীবিকা অর্জনের বৈচিত্রময় উপায়ের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। গবেষণাটি একটি দৃঢ় পারিবারিক জরুরি পরিকল্পনা, বন্যার সময় ঘরবাড়ি রেখে অন্যত্র চলে যাওয়ার উন্নত পদ্ধতি এবং বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় একটি লক্ষ্যকেন্দ্রীক ‘ক্যাশ+’ পদ্ধতির কথা বলে। সামগ্রিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য পারিবারিক ও সম্প্রদায়-পর্যায় উভয় কৌশলের ওপর জোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা-পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পৃক্ততাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়মিত পরামর্শমূলক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের মতো প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা অত্যাবশ্যক। বন্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং কমিউনিটি পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর পদ্ধতির বিস্তৃতির মতো বিষয়গুলো মূল সুপারিশ হিসেবে উঠে এসেছে।