মনিকার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন যেভাবে ১২ বছরের দিঘীর জীবন বদলে দিল
মনিকার ল্যাট্রিনের (শৌচাগার) ব্যবসায় সফলতা তার কমিউনিটিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। সেই সঙ্গে বদলে দিয়েছে ১২ বছর বয়সী দিঘীর জীবনও।
নওগাঁ, বাংলাদেশ
“বাবা, তাড়াতাড়ি চলো!” দিঘী তার বাবা মো. মাজেদ আলী মণ্ডলকে উদ্দেশ্য করে বলল। বাবা-মেয়ে দুজনে মিলে যাচ্ছিলো ইউনিসেফের সহায়তায় মোসাম্মৎ মনিকা বেগমের চালু করা ল্যাট্রিনের দোকানে। দিঘীদের গ্রামে এই দোকানেই কেবল ল্যাট্রিন পাওয়া যায়।
মনিকাকে দেখেই যেন দীঘি আরও জোরে হাঁটা শুরু করল, তার চোখ-মুখও খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শান্ত স্বভাবের দিঘী তার উত্তেজনা যেন আর ধরে রাখতে পারছিল না। গত ছয় মাস ধরে সে এই মুহূর্তের স্বপ্ন দেখেছে এবং বাবা-মায়ের কাছে বার বার একটি নতুন ল্যাট্রিনের জন্য আবদার করেছে। বাড়িতে একটি ভালো ল্যাট্রিন হলে তার আর বাইরে ল্যাট্রিন খুঁজে বেড়ানো লাগবে না।
“আমাদের আগের ল্যাট্রিনটা ভালো ছিল না। সেখানে দুর্গন্ধ হত
এবং অনেক পোকামাকড় আসত”, ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া দীঘি বলল
রাপত্তাহীনতায় দিঘী
দিঘী কয়েক মাস ধরে স্যানিটেশন ব্যবসার দোকানটিতে যাওয়া-আসা করছিলো। সেখানে মনিকা ও তাঁর স্বামী মো. হাতিম সারি সারি করে নিজেদের তৈরি করা পিট ল্যাট্রিন১ সাজিয়ে রেখেছে। সেগুলো ছিল নানা রঙের ও নানা ধরনের। দোকানটি গ্রামের মূল সড়কের সামনে। গাছপালায় ঘেরা ওই জায়গায় শিশুদের কোলাহল শোনা যায়। প্রতিদিন এখান দিয়ে হেঁটে যায় দিঘী। সে জানত, তার গ্রামের অন্যান্য পরিবার মনিকার কাছ থেকে ল্যাট্রিন কিনছে। দিঘী বলে, “অন্যান্য বাড়িতে আমি ভালো ল্যাট্রিন দেখেছি। আমাদের স্কুলে শিক্ষকেরাও বলতেন যে, আমাদের পরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহার এবং টয়লেট কেন্দ্রিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (হাইজিন) মেনে চলা উচিত।”
ল্যাট্রিন ব্যবহারের পর দিঘী খুব ভালোভাবে সাবান দিয়ে তার হাতদুটো ধুয়ে নিচ্ছে। সে স্যাটোট্যাপ ব্যবহার করছে। এটা ইউনিসেফের সহায়তায় দেওয়া একটি উদ্ভাবনীমূলক হাত ধোয়ার ডিভাইস।
দিঘী দীর্ঘ সময় ধরে অস্বস্তির সাথে তাদের বাড়ির টয়লেট ব্যবহার করে আসছে। তাদের ঘরটি ছোট। সেটার কাছেই দুর্গন্ধময় ল্যাট্রিন ছিল, যেখানে পোকামাকড় থাকত। এই ল্যাট্রিন ছিল তাদের খোলা রান্না ঘর থেকে দুই পা দূরে। ওই রান্না ঘরেই মাকে খাবার তৈরিতে সাহায্য করত মেয়েটি।
একটি পরিষ্কার টয়লেট পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে দিঘী তার মা-বাবার মানসিকতায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তাদেরকে সবভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। এমনকি নতুন টয়লেট না হলে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ারও হুমকি দেয়।
এরপরেও দিঘীর বাবা-মা তার কথায় রাজি হচ্ছিল না। এটা করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তারা।
ওই ঘটনা স্মরণ করে দিঘীর বাবা মাজেদ বলেন, “ওই সময় আমাদের কাছে টাকাও ছিল না। একটি ভালো ল্যাট্রিনের সুবিধাগুলো কী কী, তাও আমরা বুঝতাম না।” গ্রামের বাজারে শাকসবজি বিক্রি করা মাজেদই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
দিঘীর মা আমিনা বিবি ওই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, “তখন কিন্তু দিঘী নিয়মিত অসুস্থ হয়ে পড়ত। ডায়রিয়ার মতো পেটের সমস্যা লেগেই থাকত।”
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে খোলা জায়গায় মলত্যাগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট এখনো অনেকের নাগালের বাইরে, বিশেষ করে দিঘীদের মতো স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর জন্য। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা ভাঙাচোরা একটি ল্যাট্রিন ব্যবহার করেন। তাতে শিশুরা সরাসরি মানুষের মলমূত্র, দূষিত পানির সংস্পর্শে আসে এবং এভাবে রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়ে।
একটি নতুন ল্যাট্রিন কেনা তাদের জন্য অনেকগুলো টাকার ব্যাপার হলেও আমিনা ও মাজেদ মেয়ে দিঘীর ভালোটাই চান। মেয়ের জেদের কাছে হার মানার পরেও তারা মনিকার কাছে পরামর্শ চাইলে তিনিও আশ্বস্ত করেন যে, দিঘী ঠিকটাই বলছে। তাদের মানসম্মত স্যানিটেশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা শুধু তাদের মেয়ের স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, তার নিরাপত্তা, মানসিকভাবে ভালো থাকা ও শিক্ষার জন্যও দরকার।
একজন নারী উদ্যোক্তা, যিনি নিজের গ্রামকে বদলে দিয়েছেন
দোকানে মনিকা নিজেদের তৈরি করা কংক্রিটের রিংগুলো পরিষ্কার করছেন। এসব কংক্রিটের রিং মাটি খুঁড়ে তৈরি করা গর্তে বসানো হয়, মানুষের ত্যাগ করা মলমূত্র তার ভেতরে ধরে রাখার জন্য।সৌজন্যে: ইউনিসেফ বাংলাদেশ/২০২৩/হিমু
৪০ বছর বয়সী মনিকা একজন নারী উদ্যোক্তা, যিনি নিজের ভাগ্য বদলেছেন; দিঘীর গ্রামে মনিকা ভালোভাবেই পরিচিত। মনিকার রয়েছে দারুণ উপস্থিত বুদ্ধি। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং সর্বোপরি কঠিন সময়কে চমৎকারভাবে সামলে নিতে সক্ষম।
প্রথম দিকে তার ব্যবসা মোটেও সহজ ছিল না। মনিকা উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
সে সময়ের কথা মনে করে মনিকা বলেন, “তখন আমি খুব গরিব ছিলাম । দেখেছিলাম লোকজন এসব জিনিসি বিক্রি করে। ব্যবসা শুরু করার টাকা জোগাড় করার জন্য আমরা বাড়ির গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করে দিই। ঘরে বসে ল্যাট্রিন তৈরি করার জন্য আমি কিছু উপকরণ সংগ্রহ করি, কিছু কিনে আনি। প্রথম দিকে তেমন কোন বিক্রিই ছিল না।”
মনিকা তার কাছে থাকা সব টাকা-পয়সা নিয়ে, মনপ্রাণ দিয়ে এ কাজে লেগে পড়েন। কয়েকবার স্বামীকে ল্যাট্রিন বানাতে দেখার পর নিজের হাতেই তা বানাতে শুরু করেন। শুরুতে, মনিকা প্রত্যাশানুযায়ী ফল পাচ্ছিলেন না; এরপর তিনি ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট সান মার্ক সিস্টেমস ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টে যোগ দেন, তারপর থেকে তার ব্যবসা বাড়তে থাকে।
মনিকা বলেন, “যখন ইউনিসেফ ও এর পার্টনার (অংশীজন) আইডিই এর থেকে প্রশিক্ষণ নিলাম, তারপর থেকে ল্যাট্রিন বানানো শুরু করে সফলতা পেতে থাকলাম।” তিনি বলেন, “প্রশিক্ষণে আমি শিখলাম যে, অপরিষ্কার টয়লেট থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, সেখানে পোকামাকড় আসে এবং রোগ-বালাই তৈরি হয়। তাই আমরা ঢাকনাসমেত টয়লেট তৈরি করতে শুরু করলাম। এই পিট টয়লেট কোথায় কীভাবে বসাতে হয়, সে বিষয়েও আমরা জানলাম। কীভাবে এই টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ রাখতে হয়- এমন অনেক কিছু আমরা শিখলাম।”
ইউনিসেফ অংশীজনদের নিয়ে বাংলাদেশের ২৫টি জেলায় মনিকার মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়নে ভূমিকা রেখেছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি কমিউনিটিতে নিরাপদ স্যানিটেশন চর্চা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্যানিটেশন পণ্যের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এর ফলে শিশু ও তাদের পরিবারগুলো উপকৃত হচ্ছে। নওগাঁয় মনিকার ব্যবসার ফলে তার কমিউনিটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ল্যাট্রিন সম্পর্কে সচেতন হয়েছে; তা দিঘীর জীবনেও উন্নয়ন ঘটিয়েছে। মনিকা গর্বের সঙ্গে বলেন, “আমি একজন নারী হয়ে ব্যবসা করছি। এটা নিয়ে লোকজন অনেক কথা বলতে পারে। কিন্তু আমার ব্যবসায় অনেক মানুষের মঙ্গল হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “এখন আর ওই প্রকল্প থেকে সহায়তা না পেলেও আমি এই ব্যবসা চালিয়ে নিতে এবং এটা আরও বড় করতে পারব বলে আত্মবিশ্বাসী।”
বার হাত ধরে দিঘী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি পিট ল্যাট্রিন পরীক্ষা করে। মাঝে মাঝে সে তার বাদামী রঙের স্যান্ডেলগুলো খুলে খুব সতর্কভাবে প্রতিটি ল্যাট্রিনের ওপর দিয়ে হাঁটছিল। শেষ পর্যন্ত সে গোলাপী রঙের মেঝেতে সাদা টাইলস বসানো একটি ল্যাট্রিন পছন্দ করে।
দিঘী বলে, “নতুন ল্যাট্রিন দেখে আমার খুবই আনন্দ হচ্ছিল। কারণ আমি নিজে দোকানে গিয়ে এটা পছন্দ করেছিলাম। এটায় টাইলস আছে এবং এটা রঙিনও।”
এখন বাড়িতে দিঘী নিরাপদে ও স্বস্তির সাথে মানসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে পারে। এখন আর পরিষ্কার টয়লেট খুঁজতে তাকে একা বাইরে যেতে হয় না। তার এখন আর আগের মতো অসহায় লাগে না; দিঘী আর আগের মতো ঘন ঘন অসুস্থও হয়ে পড়ে না। এখন দিঘী প্রতিদিন স্কুলে যায়। নিজের লক্ষ্য অর্জনে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারে।
মো. মাজেদ আলী মণ্ডল তার এক সন্তানকে হারিয়েছে। দিঘী এখন তার নিজের ও তার বাবা-মার স্বপ্ন পূরণে এগোচ্ছে।
“ভবিষ্যতে আমি একজন চিকিৎসক হতে চাই,” জানায় দিঘী; ক্লাসে এবার দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে সে।
বাংলাদেশে শিশুদের উন্নয়নে অব্যাহত সহায়তা ও আসামান্য অবদানের জন্য সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে ইউনিসেফ।